প্রথমটিই ‘পরিত্যক্ত', হচ্ছে আরও দুটি ফুট ওভারব্রিজ
২০১৫ সালে সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকার কোর্ট পয়েন্টে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় সিলেটের প্রথম পদচারী-সেতু (ফুট ওভারব্রিজ)। এরপর প্রায় ছয় বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেতুটি। একাধিকবার বিক্রির উদ্যোগ নিয়েও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় সেতুটি এখন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) গলার কাঁটা হয়ে আছে।
এ অবস্থায় নগরে আরও দুটি পদচারী-সেতু নির্মাণ করছে সিলেট সিটি করপোরশেন। প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে এ সেতু দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে টিলাগড়ে একটি সেতুর কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আরকেটির স্থান এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে হুমায়ূন রশীদ চত্বর অথবা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সেতুটি নির্মাণের ব্যাপারে আলোচনা চলছে।
নগরের বাসিন্দারা বলছেন, অর্থের লুটপাটের জন্য এসব অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো নগরবাসীর কোনো উপকারে আসবে না। কেবল রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ঘটে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সিটি মেয়রের আগ্রহে নগরের টিলাগড় পয়েন্টে মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের পাশে একটি ও উপশহর পয়েন্টে আরেকটি পদচারী সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে টিলাগড়ের পদচারী সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। অপর সেতুর কাজ এখনও শুরু হয়নি। এই দুটি সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
সোমবার টিলাগড় পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, কোর্টপয়েন্টের মতো এই সেতুটিও ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ ব্যবহার করছে না। সেতুর নিচ দিয়েই পথচারীরা হেঁটে সড়ক পার হচ্ছেন।
তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজ ও সরকারী কলেজ খুললে পদচারী সেতুটির ব্যবহার বাড়বে। শিক্ষার্থীরা সেতু ব্যবহার করে সড়ক পার হবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিচেনা করেই এটি নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে শিক্ষার্থীদের নয়, সন্ত্রাসীরাই এই সেতুর মাধ্যমে সুবিধা পাবে বলে মনে করেন সিলেটের নাগরিক সংগঠন সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম।
তিনি বলেন, টিলাগড় এলাকায় বেশ কয়েকটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের দলাদলির কারণে প্রায়ই মারামারি লেগে যায়। এখন দেখা যাবে, যে গ্রুপ ফুটওভারব্রিজের দখল নিতে পারছে তারা মারামারিতে সুবিধা পাচ্ছে। ফলে এটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সংঘাতেই বেশি ব্যবহৃত হবে।
তিনি বলেন, এর আগে নগরের কোর্টপয়েন্ট এলাকায় একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। এটি নগরবাসীর কোনো কাজে লাগে না। বরং এই এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এই সেতু। কারণ কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় সবসময় সভাসমাবেশ হয়। ওই ফাঁকা সেতুর উপর থেকে যে কেউ এসব সভা-সমাবেশে আক্রমণ করে বসতে পারে।
তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, পুরনো সেতুটি কাজে না লাগালেও নতুন দুটি প্রয়োজনের তাগিদেই নির্মিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, পদচারী সেতু ব্যবহারে আমাদের আগ্রহ ও সচেতনতা কম। তবে এগুলো অপ্রয়োজনীয় নয়। মানুষকে সেতু ব্যবহারে সচেতন করতে হবে।
এই প্রকৌশলী বলেন, টিলাগড় দিয়ে অনেক ট্রাক চলাচল করে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য পদচারী সেতু জরুরী
এ ব্যাপারে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এরআগে, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আগ্রহে ২০১৫ সালে এক কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরের বন্দর বাজার এলাকার কোর্ট পয়েন্টে নির্মাণ করা হয় সিলেটের প্রথম পদচারী সেতু। স্থাপনের পর থেকেই এটি অব্যবহৃত থাকায় এটি নিলামে বিক্রি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয় সিসিক।
বিক্রির জন্য পর পর দুবার দরপত্রও আহ্বান করা হয়। কিন্তু নিলামে এক কোটি ৬৩ লাখ টাকায় নির্মিত এই সেতুর দাম উঠে মাত্র ২২ লাখ টাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেতুটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সিটি কর্পোরেশন। এরপর সিদ্ধান্ত হয় এটি নগরের দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বরে সরিয়ে নেয়ার। তবে সেটিও পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়ে গেছে এখনো। অপ্রয়োজনীয় এই সেতুটি এখন সড়ক সম্প্রসারণ ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের জন্য উপদ্রব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী জানান, এই পদচারী-সেতু বিক্রির জন্য দুই দফা নিলাম আহ্বান করা হয়। কিন্তু ২২ লাখ টাকার বেশি কেউ দিতে চায়নি। চাহিদামতো দাম না পাওয়ায় এটি বিক্রি করা হয়নি। এখন সেতুটি স্থানান্তরেরও কোনো পরিকল্পনা নেই।
এই সেতুর পাশেই মধুবন সুপার মার্কেট। এই মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সেতুটি নির্মাণের সময়ই আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। এত ছোট সড়কে পদচারী-সেতুর কোনো প্রয়োজন নেই। উল্টো সেতুর ভিত তৈরি করতে গিয়ে আমাদের মার্কেটকে পুরো আড়াল করে দেওয়া হয়েছে। এতে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আমাদের আপত্তি আমলে নেননি।'
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সদস্য মুনির হেলাল বলেন, 'সিটি করপোরেশনের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, পথচারীরা ব্যবহার করতে আগ্রহী না, এমন স্থানে বিলাসবহুল পদচারী সেতুসহ নানা বিলাসী চিন্তাভাবনা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। এতে জনগণের অর্থের অপচয় হচ্ছে। কিন্তু জনগণের কোনো উপকার হচ্ছে না।'