বন্ধ পাটকল শ্রমিকদের অনিশ্চিত জীবন, ঘোষণা থাকলেও হয়নি বকেয়া পরিশোধ
৬০ দিন পার হয়ে গেল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধের সময় দুই মাসের বেসিক বেতনের টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল দুই মাসের মধ্যে চাকরি হারানো শ্রমিকদের সকল দেনা-পাওনা একসঙ্গে পরিশোধ করা হবে। সংস্কার করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চালু করা হবে। মিল বন্ধের দুই মাস পার হয়ে গেলেও আমাদের কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। গত বছরের ছয়টি বিলও বাকি। মিল চালুরও কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। আমরা এখন চরম হতাশার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছি।
মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে ক্রিসেন্ট জুট মিলের সামনে গত বছরের ছয়টি বকেয়া বিলের টাকা নিতে আসা চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা হতাশার সুরে এভাবেই তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন।
ক্রমাগত লোকসানের কারণে গত ২৫ জুন খুলনা অঞ্চলের নয়টিসহ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর ২ জুলাই পাটকল বন্ধসহ গোল্ডেন হ্যানডশেকের আওতায় শ্রমিকদের অবসায়নের প্রজ্ঞাপন মিলে মিলে নোটিস বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়।
এ সময় সরকার প্রতিশ্রতি দেয় সংস্কার করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চালু করা হবে। তবে, বন্ধ ঘোষিত মিল চালুর ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র।
খুলনাঞ্চলের বন্ধ হওয়া নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল হচ্ছে, ক্রিসেন্ট জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, স্টার জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, আলিম জুট মিল, জেজেআই জুট মিল ও কার্পেটিং জুট মিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেএমসির একজন কর্মকর্তা জানান, প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে প্রজ্ঞাপনে শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সদ্য অবসরে যাওয়া খুলনা অঞ্চলের সাতটি জুট মিলের আট হাজার ১০০ শ্রমিক ও আগের অবসরে যাওয়া আরো প্রায় এক হাজার শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের জন্য সরকারের প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। তবে, খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিলে দৈনিকভিত্তিতে (অস্থায়ী শ্রমিক) কাজ করা কোনো শ্রমিক সরকারি কোনো সুবিধা পাবে না।
বিজেএমসির সূত্রমতে, ২০১৩ ও ১৪ সাল থেকে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল থেকে প্রায় এক হাজার শ্রমিক অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘ ৬-৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তারা টাকা পাননি। অনেক চেষ্টা-তদ্বির করে কেউ কেউ প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পেলেও মজুরি কমিশন ও গ্র্যাচুইটির টাকা এখনো পায়নি।
ক্রিসেন্ট জুট মিলের বেসিং বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক মনসুর আলী বলেন, মিল বন্ধের সময় দুই মাসের (জুন-জুলাই) বেসিকের ২৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু বেতন ও গ্র্যাচুইটিসহ অন্যান্য কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
তিনি বলেন, মিল বন্ধের সময় বলা হয়েছিল আগস্ট মাসের মধ্যে এককালীন সকল বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হবে। এখন মিল কর্তৃপক্ষের কোনো খবর নেই। কথা বলার জন্যও মিলের কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় না। স্ত্রী আর ছয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।
ক্রিসেন্ট জুট মিলের সিবিএ'র সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ ফরিদ হতাশার সুরে বলেন, আমাদের ইস্তফার কোনো কার্যকারিতা পাচ্ছি না। বকেয়া টাকারও কোনো খবর নেই। তারপরও এখনো আশা নিয়ে আছি, আমরা আমাদের বকেয়া টাকা এক সঙ্গে পাবো। মিল বিএমআরই (সংস্কার) করে আবার চালু হবে। আমরা আবার কাজে ফিরতে পারব।
ক্রিসেন্ট জুট মিলের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) মো. কালাম মল্লিক বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। শ্রমিকদের বকেয়া ছয়টি বিলের ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, বন্ধ ঘোষিত মিল চালুর ব্যাপারেও আমাদের কোনো কিছু জানা নেই।
প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের অবসরপ্রাপ্ত নিরাপত্তা প্রহরী আব্দুল জলিল বলেন, তিনি ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। এরপর তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালতের রায়ে তার এক বছর চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এরমধ্যে ২০১৫ সালে তিনি নতুন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার পর তিনি বেতন ও গ্র্যাচুইটিসহ বকেয়া পাওনা প্রায় ১৫ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য মিল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তার বকেয়া টাকা পাননি।
তিনি বলেন, স্ত্রী, পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে। কোনো কোনো দিন উপোষও থাকা লাগে। মিল কর্তৃপক্ষ আমার বকেয়া পাওনা পরিশোধ করলে এই বৃদ্ধ বয়সে একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।
ইস্টার্ন জুট মিলের শ্রমিক গোলাম মোস্তফা বলেন, ভ্যান-রিকশা চালিয়ে সংসার চালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এভাবে থাকলে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাবে।
বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়ক (লিয়াজোঁ অফিসার) গোলাম রব্বানী বলেন, অবসরপ্রাপ্ত আট হাজার ১০০ শ্রমিকের দুই মাসের বেসিকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে, বেতনসহ অন্যান্য বকেয়া এখনো পরিশোধ করা হয়নি। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই।
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। আশা করছি আট/দশ দিন পর বকেয়া পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হবে।