বন্যায় পানের বরজে হাঁটুপানি, চাষিদের মাথায় হাত
করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই দাম না পাওয়ায় লোকসানে রয়েছেন রাজশাহীর পানচাষীরা। এরই মধ্যে ''মরার উপর খাড়ার ঘা' হিসেবে যুক্ত হয়েছে বন্যা। জেলার বাগমারা ও মোহনপুর উপজেলার কয়েকশ' বরজে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে অন্তত কোটি টাকার পান। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম পানবরজ বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেক কৃষক।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর জেলায় চার হাজার ৩১১ হেক্টর জমিতে পান উৎপাদন হয় ৬৮ হাজার ৯৭৬ টন। পান উৎপাদনের সঙ্গে রাজশাহীর ৬৯ হাজার ২২৮ জন কৃষক জড়িত আছেন। বছরে রাজশাহীতে প্রায় সাড়ে ১১০০ কোটি টাকার পানের ব্যবসা হয়। তবে এ বছরের বন্যায় মোহনপুর ও দুর্গাপুরে ২০ হেক্টর জমির পান নষ্ট হয়ে গেছে।
সংস্থাটি আরও জানায়, এক হেক্টর জমিতে পান উৎপাদন হয় ১৬ টন। গড়ে ৪০ টাকা বিড়াপ্রতি পানের দাম ধরলে এক টন পানের দাম দাঁড়ায় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। সে হিসেবে এক হেক্টর জমিতে বন্যায় ২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার পান নষ্ট হয়েছে। ২০ হেক্টর জমিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ১২ লাখ টাকা।
বাগমারা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভা এলাকায় ১৫৫০ হেক্টর জমিতে পানের চাষাবাদ করা হয়। অনেক ইউনিয়নে কৃষকদের উপার্জনের একমাত্র পথ হলো বরজের মাধ্যমে উৎপাদিত পান। এক সপ্তার ব্যবধানে উপজেলায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় চারশ পান বরজে পানি ঢুকে পড়েছে।
গত সপ্তাহে উপজেলার দ্বীপপুর ইউনিয়নের লাউবাড়িয়া গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গিয়ে আশে-পাশের ছয়টি গ্রামে পানি ঢুকে বাড়িঘর, ফসলাদি ও পান বরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর টানাবর্ষণে বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে।
লাউবাড়িয়া গ্রামের পানচাষি সিদ্দিকুর রহমান জানান, তার বরজটি বাঁধ ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে যায়। এতে তিনি প্রায় পাঁচ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
পান বরজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের উদপাড়া, বাজে গোয়ালকান্দি ও সেনোপাড়া গ্রামে। সেনোপাড়া গ্রামের কৃষক আসাদুল ইসলাম জানান, তার তিনটি পান বরজের দুইটাই তলিয়ে গেছে।
একই গ্রামের আয়াত শাহ, আবুল আজাদ, রমজান শাহ, ফেরদৌস, আরিফ, আজাদুল, সান্টু, রেজাউল, আয়ের উদ্দিন, মোজাহার আলীসহ প্রায় শতাধিক কৃষকের প্রায় তিনশ' পান বরজ তলিয়ে গেছে।
রাজশাহীর মোহনপুরের বেলাল হোসেন জানান, ১০ কাঠা জমি লিজ নিয়ে গত দুই বছর আগে পানের বরজটি তৈরি করেছিলাম। গত ১৫ দিন আগে পানের বরজে বন্যার পানি ঢুকেছে। পানি আর বের হয়নি। পানি থাকার কারণে গাছের গোড়া পচে পান বরজ পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আমার কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার পান নষ্ট হয়েছে। আর রক্ষণাবেক্ষণ ধরলে দেড় লাখ টাকার মতো লোকসান হবে।
তিনি জানান, পান বরজে একবার পান লাগালে ৪০/৫০ বছর ধরে বেঁচে থাকে। বারবার নতুনভাবে লাগানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু পানবরজে পানি জমে থাকলেই পান বরজ শেষ। আমার এই পান বরজ করা মাত্র দুই বছর হয়েছে। এখন আবার নতুনভাবে করতে হবে। একটা পানবরজ তৈরি করতে গেলে শুরুতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়।
মোহনপুরের আমরাইল গ্রামের পানচাষি মো. স্বপন জানান, গত কয়েকদিনের বন্যার পানিতে পানের বরজে হাঁটু সমান পানি জমে গেছে। এতে পুরো পানবরজের পান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন উপার্জনের পথই বন্ধ হয়ে গেল।
''আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে পানের বরজ। সেই পানবরজটাই পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেলো। এমনিতেই করোনা ভাইরাসের কারণে পানের দাম ছিল। সেখানে এই বন্যা পুরো আয়ের পথটাই বন্ধ বন্ধ করে দিল'', যোগ করেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, পান বরজ তলিয়ে যাওয়ায় পানিতে নেমেই অধিক পরিশ্রমে পান সংগ্রহ করে বাধ্য হয়েই বাজারজাত করতে হচ্ছে। অনেকেই আত্মীয়-স্বজন এনে পান সংগ্রহের কাজে লাগিয়েছেন। পানিতে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পান।
স্থানীয় পান চাষি নান্টু বলেন, বাজারে গিয়ে পান বিক্রি করে শ্রমিকের খরচই উঠছে না।
রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল হক জানান, রাজশাহীর বাগমারায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানের বরজ তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলার বেশিরভাগ পানবরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর মোহনপুরে বৃষ্টির পানিতে নিম্নাঞ্চলের অনেক পানবরজের মধ্যে পানি ঢুকে গেছে।