বন বিভাগের পর্যটন বিকাশের ঝোঁকে ঝুঁকির মুখে সিলেটের বনাঞ্চল
দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল। পর্যটকদের অবাধ যাতায়াতের ফলে বিরল প্রজাতির এই বনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তাই বনের ভেতরে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবিদরা।
তবে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এ বনে দর্শনার্থী প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি মাস থেকে প্রতি দর্শনার্থী প্রবেশে ৫০ টাকা (ভ্যাটসহ ৫৭ টাকা) ফি নির্ধারণ করা হয়। এর মাধ্যমে বনের ভেতরে পর্যটকদের প্রবেশকে আরও উৎসাহিত করা হয়েছে বলে দাবি পরিবেশকর্মীদের।
এর আগে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের জন্য 'ট্রি অ্যাকটিভিটি' বা 'দড়িপথ' চালু করে বনবিভাগ। এরপর এ উদ্যানে টিকিটের মাধ্যমে দর্শনার্থী প্রবেশ করানো শুরু হয়।
একইভাবে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি সংরক্ষিত বনসহ কয়েকটি বনে অনেকদিন ধরেই টিকিটের মাধ্যমে পর্যটক প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে পর্যটকদের অবাধ বিচরণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব বনের পরিবেশ।
অথচ লোকবল সঙ্কটে প্রায় চার বছর ধরে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে লাউয়াছড়ার একমাত্র ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারটি। বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে গেছে সড়ক ও রেলপথ। এইসব সড়কে গাড়ির চাপায় পিষ্ঠ হয়ে প্রায়ই হতাহত হয় বণ্যপ্রানী। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় রেসকিউ সেন্টারে চিকিৎসা পাচ্ছে না আহত বন্যপ্রাণী। এই সেন্টারটি চালুর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই।
এছাড়া সিলেটে বনবিভাগের প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৪ একর জমির মধ্যে প্রায় ৫৮ হাজার একরই বেদখলে রয়েছে। নতুন করেও বেদখল হচ্ছে অনেক জমি। প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমি বেদখলে থাকলেও তা উদ্ধারে বনবিভাগের তৎপরতা সামান্যই। বন ও বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় বনবিভাগের উদাসীনতার বিপরীতে বনের মধ্যে পর্যটনের বিকাশে তাদের তৎপরতা লক্ষনীয়। বনে পর্যটক আকর্ষণে নেওয়া হচ্ছে একের পর এক প্রকল্প।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, "বন ও বণ্যপ্রাণীর সুরক্ষার জন্য বনবিভাগ গঠন করা হয়েছে। পর্যটনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি বনবিভাগই পর্যটন বিকাশের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে, তাও বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস করে,"
তিনি বলেন, "রাতারগুল জলারবন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সারাদেশের সম্পদ। কিন্তু বনবিভাগের উদাসীনতায় দিনদিন এই বনগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। গাছ কাটা হচ্ছে। পর্যটকদের অবাধ বিচরণের কারণে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে ওঠেছে পর্যটকদের বিচরণ। এ অবস্থায় যখন বনের ভেতরে পর্যটকদের প্রবেশ সীমিত করা প্রয়োজন তখন বনবিভাগ পর্যটন শিল্পের বিকাশের নামে বনের ভেতরে স্থাপনা নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে যা বন ও বন্যপ্রাণীকে হুমকীতে ফেলবে।"
তবে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এসএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "বন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো উদ্যোগই নেওয়া হচ্ছে না। বরং বনের সুরক্ষায় পর্যটকদের যাতে একস্থানে আটকে রাখা যায় সে পরিকল্পনা থেকেই এসব করা হচ্ছে,"
তিনি বলেন, "রাতারগুলে পর্যটকদের প্রবেশ সীমিত করতেই টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।"
বনবিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন বিভাগের পক্ষ থেকে গতবছর 'লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকো-পার্কে বনায়ন ও ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন' নামে ৩৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এতে বর্ষিজোড়া ইকোপার্কের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের জন্য ৩ কোটি টাকা ও বাকি প্রায় ৩৬ কোটি টাকা লাউয়াছড়া উদ্যানের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই প্রকল্পে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের বসার জন্য ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি আরসিসি বসার বেঞ্চ, ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পর্যটকদের চলাচলের জন্য ব্রিজ, ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সভা-সমাবেশের জন্য কনভেনশন হল, ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর, ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে কালভার্ট, ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বনের ভেতরে সড়কের উভয় পাশে আরসিসি খুঁটিসহ প্লাস্টিক কোটেড ফেন্সিং, ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাহাড়ের উপর যাওয়ার জন্য আরসিসি সিঁড়ি, ১ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রেস্ট হাউজ, ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রেস্তোরা ও শিশুদের খেলার জায়গা, ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে লেকের উপর ঝুলন্ত সেতু, ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এছাড়া নির্মিত হবে গার্ডওয়াল, ৪টি টয়লেট, প্রবেশ গেইট, টিকিট কাউন্টার, লেইক ও পুকুরের সিঁড়ি, ওয়াচ টাওয়ার প্রভৃতি।
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১২৫০ হেক্টরের সংরক্ষিত কন লাউয়াছড়ার গাছপালা ও জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা পরিবেশকর্মীদের। পরিবেশকর্মীদের আপত্তির মুখে বর্তমানে আটকে আছে এই প্রকল্পের কাজ।
পরিবেশবাদী সংগঠন ভ'মিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, "পর্যটনের জন্য অনেক জায়গা আছেন। সংরিক্ষত বনের ভেতরে পর্যটন বিকাশ কেনো? রাতারগুল, লাউয়ছড়া, খাদিম এধরণের বিরল প্রজাতির বন জীববৈচিত্র ও বণ্যপ্রাণীর জন্যই সুরক্ষিত রাখা উচিত,"
তিনি বলেন, "এর আগে রাতারগুল বনের ভেতরে পর্যটকদের সুবিধায় ওয়াচ টাওয়ারসহ বেশ কিছু স্থপনা নির্মাণ করে বন বিভাগ। বনকে এখন ইট-সিমেন্টের স্তুপে পরিণত করা হচ্ছে।"
তবে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, "সরকার বনের সুরক্ষায় সবসময় আন্তরিক। বনের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্পই নেয়া হবে না। 'লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকো-পার্কে বনায়ন ও ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন' প্রকল্পও পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।"