বাংলাদেশে স্মার্টফোন উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নোকিয়া
সারা বিশ্বে সুপরিচিত, ফিনল্যান্ডের মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান 'নোকিয়া' প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন ইউনিট শুরু করতে যাচ্ছে। স্যামসাং, অপ্পো ও রিয়েলমির মতো সমাদৃত ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে এবং নোকিয়াও তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার এবং বাংলাদেশের ইউনিয়ন গ্রুপের জয়েন্ট ভেঞ্চার ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার (বিডি) লিমিটেড বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে এ বছরের মার্চে স্থানীয় পর্যায়ে নোকিয়া ফোন উৎপাদনের অস্থায়ী লাইসেন্স পেয়েছে।
এই মুহূর্তে এই যৌথ উদ্যোগটি জাতীয় রাজস্ব বিভাগের (এনআরবি) ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ছাড়পত্র পাওয়ার পরেই তারা উৎপাদন শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম আমদানির জন্য এলসি খুলবে বলে 'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'-কে জানান শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে কারখানা নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য তারা ৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়। তারা জানান, ঈদুল ফিতরের আগেই উৎপাদন আরম্ভের কথা থাকলেও, কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে কোম্পানিটি তাদের পরিকল্পনা বদলেছে।
চার বছর আগে বৈশ্বিক মোবাইল বাজারে নিজেদের প্রত্যাবর্তন ঘটায় নোকিয়া। নোকিয়ার প্রত্যাবর্তনের পেছনে কাজ করা প্রতিষ্ঠান- এইচএমডি গ্লোবাল নোকিয়ার স্মার্টফোনগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করার মাধ্যমে বাজারে তাদের চাহিদা ফিরিয়ে আনে এবং সেই সাথে বাজার অংশীদারিত্বও বৃদ্ধি করেছে তারা।
তবে একসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফোন ব্র্যান্ড হিসেবে নোকিয়ার যে সুনাম ছিল তা এখন কমেছে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু, নোকিয়ার 'ব্লোটওয়্যার-ফ্রি' ভোক্তা অভিজ্ঞতার সুবিধা অন্য ব্র্যান্ডের চাইতে একে অনন্য বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে, প্রবেশ পর্যায়ের এবং বাজারের অন্যান্য বাজেট সেগমেন্টের স্মার্টফোনের তুলনায় নোকিয়ার একটি স্বতন্ত্রতা রয়েছে।
বাংলাদেশেও স্মার্টফোনের বাজার তৈরিতে নোকিয়া একই সেগমেন্টে বিকাশে মনোযোগ দেবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের একটি অঙ্গসংগঠন, গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড গতবছর নোকিয়ার ভেন্ডরশিপ (পণ্য সরবরাহকারী) নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু বিটিআরসি তা নাকচ করে দেয় বলে ঘটনা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
নোকিয়া বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন শুরু করলে অ্যাপল, হুয়াওয়ে ও শাওমি ছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বের প্রায় সকল স্বনামধন্য মোবাইল ফোন কোম্পানির উৎপাদন ইউনিট থাকবে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ইউনিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল কবির বলেন, "আমরা বাংলাদেশে নোকিয়া স্মার্টফোন তৈরি করব। সবকিছু পরিকল্পনা মোতাবেক চললে, খুব শীঘ্রই বাংলাদেশি ক্রেতারা দেশীয়ভাবে তৈরি নোকিয়ার মুঠোফোন পাবেন।"
বাংলাদেশে নোকিয়ার আঞ্চলিক অফিস এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
এই ইস্যুতে মন্তব্য করতে বললে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুল জব্বার বলেন, "বিটিআরসি ভাইব্র্যান্ট (বিডি) লিমিটেডকে দেশে নোকিয়ার মুঠোফোন উৎপাদনের জন্য অস্থায়ী লাইসেন্স দিয়েছে। আরো কিছু ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে তাদের কারখানা নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমি আশাবাদী যে, ২০২২ সালের মধ্যে নোকিয়াকে অনুসরণ করে অন্যান্য কোম্পানিও যদি কারখানা চালু করে, তাহলে বাংলাদেশ নিজ দেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেট দিয়েই স্থানীয় বাজার চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।"
গুণগত মান ও স্থায়ীত্বের জন্য বাংলাদেশের বাজারে আসার শুরু থেকেই নোকিয়া ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সংশ্লিষ্ট শিল্পখাতের ব্যক্তিরা প্রত্যাশা করেছিলেন যে বাংলাদেশে নতুন কোম্পানিগুলো কারখানা তৈরির আগেই একসময়ের শীর্ষ এই ব্র্যান্ডটি তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করবে। কিন্তু, বিগত কয়েক বছর ধরেই নোকিয়া বিটিআরসি'র অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করলেও অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে এতদিন তা হয়ে উঠেনি।
২০১৭ সালের ২৪ শে মে সামিট গ্রুপের একটি অঙ্গসংগঠন, সামিট টেকনোপলিস লিমিটেডের কাছ থেকে একটি জমি লিজ নেওয়ার চুক্তি করে ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার (বিডি) লিমিটেড।
কিন্তু কারখানা তৈরির লাইসেন্স পেতেই তাদের চার বছর লেগে যায়।
অবশেষে গত ২৩ শে মার্চ বিটিআরসি ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার লিমিটেডকে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও বন্টনের জন্য ভেন্ডর এনলিস্টমেন্ট- এর ৩ বছর মেয়াদি অস্থায়ী সনদ প্রদান করে।
এই সনদের অধীনে ভেন্ডর বা পণ্য সরবরাহকারী ৪ ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানি করার অনুমতি পাবে, তা হলো- প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড (পিসিবি) ও প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড অ্যাসেম্বলি, কমপ্লিট নক ডাউন (সিকেডি) ও সেমি নক ডাইন (এসকেডি) যন্ত্রাংশ, রেডিও যন্ত্রাংশ ও মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেন্ট উৎপাদন সম্পর্কিত অন্যান্য যন্ত্রপাতি।
নিজেদের প্ল্যান্ট তৈরির জন্য পরীক্ষামূলক ল্যাবরেটরি তৈরির যন্ত্রাংশও আমদানি করতে পারবে ভাইব্র্যান্ট।
পূর্ণাঙ্গ সনদ পাওয়ার শর্তাবলি:
বিটিআরসি থেকে 'এ' শ্রেণীর সনদ, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পেতে হলে ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার (বি ডি) লিমিটেডকে ২৫টি শর্ত পূরণ করতে হবে।
এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে- ভেন্ডরকে অবশ্যই নিজস্ব টেস্টিং ল্যাব বানাতে হবে, গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেটের অন্তত ৩ শতাংশ যেকোনো আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হবে। প্রযুক্তিগত মান ও গুণগত মান যাচাইয়ের সনদ অবশ্যই কমিশনের কাছে দাখিল করতে হবে।
এছাড়াও সেলস সার্ভিস নিশ্চিত করার জন্য তালিকাভুক্ত উৎপাদনকারীকে ঢাকায় অন্তত ৪টি, চট্টগ্রামে ৩টি এবং দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অন্তত ২টি করে সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করতে হবে।
শর্তাবলীতে আরো উল্লেখ করা হয়, বিটিআরসি'র অনুমতি ব্যতীত, মোবাইল ফোন উৎপাদন ও টেস্টিং ল্যাবরেটরির সঙ্গে সম্পর্কিত রেডিও যোগাযোগ যন্ত্রপাতির আমদানি ও রপ্তানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কমিশন কোনোরকম পূর্বনির্ধারিত নোটিশ ছাড়াই টেস্টিং ল্যাব/কারখানা / রেডিও যোগাযোগ যন্ত্রপাতির মজুদঘর বা অফিস পরিদর্শন করতে পরিদর্শক নিয়োগ দিতে পারবে বলেও জানানো হয়।
ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যও ভেন্ডরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উৎপাদিত ই-বর্জের পরিমাণ ও রিসাইক্লিং সংক্রান্ত সকল তথ্য প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টারে রেকর্ড রাখতে হবে এবং এর দ্বি-বার্ষিক প্রতিবেদন বিটিআরসি'কে জমা দিতে হবে।
এছাড়া, পুরনো বা ব্যবহৃত পিসিবি বা পিসিবিএ আমদানির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কমিশন।
দেশীয় উৎপাদন শিল্প:
দেশীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন শিল্প তার যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে। সে সময় ওয়ালটন বাংলাদেশে তাদের ইলেকট্রনিক পন্য উৎপাদন শুরু করে।
এরপর থেকে বৈশ্বিক স্মার্টফোন সরবরাহকারী কোম্পানি স্যামসাং, সিম্ফোনি, অপ্পো, রিয়েলমিসহ সর্বমোট ১০টি ব্র্যান্ড বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। দেশীয় বাজারের ৮৫ শতাংশ এসব ব্র্যান্ড উতপাদন করে থাকে এবং স্মার্টফোন ও ফিচার ফোনের দেশীয় চাহিদার ৫৫ শতাংশ পূরণ করতে পারে।
বিটিআরসি'র সূত্র অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও আমদানিকারকের সংখ্যা ছিল ২৯ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ইউনিট। এর মধ্য থেকে ১৬ দশমিক ২১ মিলিয়ন ইউনিট দেশীয়ভাবে তৈরি এবং আমদানি করা হয়েছে ১৩ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ইউনিট।
দেশীয়ভাবে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর হ্যান্ডসেট বানাতে আমদানিকৃত মোবাইলের চাইতে ৩০ শতাংশ কম খরচ হয় বলে জানান বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতির (বিএমপিআইএ) যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন।