বাষট্টির অর্ডিন্যান্সে বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি কখনও
১৯৬২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময় জারিকৃত অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছিল, “ক্যাম্পাসে ছাত্র বা শিক্ষকদের রাজনীতি থাকবে না। তবে হল সংসদগুলো বা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ কার্যক্রম চালাতে পারবে।”
বাস্তবতা হল, অর্ডিন্যান্স বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনও উদ্যোগ নেয়নি।
শুক্রবার বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। ছাত্রলীগের সদস্যদের হাতে আবরার ফাহাদের হত্যার প্রেক্ষিতে বুয়েট অডিটরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন তিনি। সেখানেই এ ঘোষণা দেন।
কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জন্য এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০০২ সালের ৮ জুন তখনকার ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোটের প্রধানতম দল দল বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদলের দুটি গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে প্রকাশ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া ক্যাম্পাসে দু’পক্ষের গুলিবিনিময়ের মাঝে পড়ে নিহত হন কেমি-কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি।
এরপর ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠা কয়েক মাসের তীব্র আন্দোলন ও ক্ষোভের মুখে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা সেখানে কার্যকর ছিল। এরপর সেখানে রাজনীতি ফিরে আসে। তবে এবার সেটা শুরু হয় প্রশাসনের মদদে।
কিন্তু আবারও দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থীর হত্যার পর বুয়েট কর্তৃপক্ষ সেখানে শিক্ষক ও ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম শুক্রবারে অডিটরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সামনে ঘোষণা দিলেন, “আজ থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ।”
আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দশ দফা দাবি নিয়ে সোমবার থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের মুখে তিনি এ ঘোষণা দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ বিষয়ক পরিচালক মিজানুর রহমান সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করেন, তিনিও কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনও যুক্ত হবেন না। অন্য শিক্ষকদেরও তিনি এমন ওয়াদা করতে আহ্বান জানান।
মিজানুর রহমান আরও বললেন, “১৯৬২ সালের অর্ডিন্যান্স থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি রয়ে গেছে।”
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে ছাত্ররাজনীতি। কেবল ২০০২ সালে সনির মৃত্যুর পর সেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন অবশ্য বুয়েটে দুটি ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে। তিনি মনে করেন, বুয়েট ক্যাম্পাস ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ আরও কিছু ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি চলছে। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নানা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।
মেনন বললেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা অনভিপ্রেত। সেখানে কোনো বাম সংগঠন অপরাধমূলক কাজকর্ম কখনও করেনি।”
কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও মনে করেন, সব দলকে একযোগে নিষিদ্ধ করা সঠিক কাজ নয়। তিনি বললেন, “ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ তাদের মূল দলগুলো ক্ষমতায় থাকার সময় লুটপাট ও সন্ত্রাস করে। সেজন্য ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ক্যাম্পাসে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত।”
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপে শিক্ষবিদ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বললেন, “ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে বড় দলগুলোর সংস্রব থাকা উচিত নয়। দুর্ভাগ্যজনক যে, ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ তাদের মূল দলের সঙ্গে পরামর্শ করে সব কিছু করে। আর সেজন্যই ক্যাম্পাসগুলোতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চলে।”
ড. আনোয়ার হোসেন মনে করেন, ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি জন্য ছাত্ররাজনীতি দরকার। তবে ক্যাম্পাস থেকে সব ধরনের সহিংস রাজনীতি দূর করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এ কে আজাদ চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষার্থীরা কাজ করবেন ন্যায়বিচার, সমতা ও গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু যদি তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে অন্যের স্বার্থ হাসিল হয় তাহলে সেটি নিষিদ্ধ করাই উচিত।
ড. আজাদের মতে, “বুয়েট প্রশাসন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। কারণ সেখানে এখন আর কোনো ছাত্ররাজনীতি নেই। সেখানে কেউ ছাত্রদের জন্য কাজ করছে না।”