বিবাদিদের গা ঢাকা, চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতে মামলা জট
চট্টগ্রামের সালেহ গ্রুপের সালেহ কার্পেট মিল, সালেহ জুট মিল, সালেহ জরিনা রুলিং মিলসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৫৮ কোটি টাকা ঋণ খেলাপির দায়ে ২০০৪ সালে মামলা করেছিল সোনালী ব্যাংক। বর্তমানে মামলাটি জারি মামলা হিসেবে রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকটির আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের ১৬ বছরে পরেও মামলাটি চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
২০০৩ সালে চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালত চালুর পর প্রতি বছর বাড়ছে মামলার সংখ্যা। বিবাদীদের ছলচাতুরির আশ্রয়, অসহযোগিতা, মামলা পরিচালনায় বাদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনাগ্রহ, মামলার তুলনায় আদালতের স্বল্পতা, মাঝে মাঝে বিচারক শূন্যতাসহ নানা কারণেই এ আদালতে মামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের মামলার ফাইলিং রেজিস্ট্রার পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই আদালতে ২০০৭ সালে ১০৬টি, ২০০৮ সালে ৭৩টি, ২০০৯ সালে ৯২টি, ২০১০ সালে ৯৭টি, ২০১১ সালে ৯৬টি, ২০১২ সালে ২২১টি, ২০১৩ সালে ৪৬৭টি, ২০১৪ সালে ৪৫৪টি, ২০১৫ সালে ৯৫৮টি, ২০১৬ সালে ৭৪৪টি, ২০১৭ সালে ৬৬৮টি, ২০১৮ সালে ৫৯৯টি এবং ২০১৯ সালে ৫৬৬টি মামলা দায়ের হয়।
অর্থ ঋণ আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ২০০৪, ০৫ ও ০৬ সালের অধিকাংশ মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। মামলার বিবাদিরা গা ঢাকা দেওয়ায় অনেক মামলা ঝুলে আছে বছরের পর বছর।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৪৪৪টি। এর মধ্যে অর্থঋণ মামলা ২১৬৯ টি, মিস মামলা ১৫৯ টি, অর্থঋণ জারি মামলা ২১১৫টি এবং অপর মামলা একটি।
২০১৯ সালে অর্থঋণ আদালতে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তি হয় ৫৪৬ টি। এছাড়া ২০১৮ সালে ৬০৭টি এবং ২০১৭ সালে ৪৫৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। তিন বছরে মামলার নিষ্পত্তি হয় ১৬১০ টি।
উচ্চ আদালতে বিবাদী পক্ষের রিট আবেদনের কারণে স্থগিত মামলার সংখ্যা ৯৮টি। যার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ৫৫টি এবং জারি মামলা ৪৩টি।
আদালত সূত্র জানায়, বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণের জন্য আদালতে যে মামলা দায়ের করে সেটি অর্থঋণ মামলা। অর্থঋণ মামলায় বাদীর পক্ষে যে রায় আসে সেটি বাস্তবায়ন কিংবা ঋণের টাকা অথবা সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য পরবর্তী সময়ে যে মামলা দায়ের করা হয় সেটি জারি মামলা।
সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট ডিভিশনের আইনজীবী এবং সালেহ গ্রুপের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের করা মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল হাসান শাহাবুদ্দিন বলেন, ২০০৪ সালে সালেহ গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলেও বিবাদী পক্ষের অসহযোগিতার কারণে মামলা এখনো চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। ঋণ নেওয়ার পর ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে টাকা পরিশোধের মানসিকতা না থাকার কারণে অর্থ ঋণ আদালতে প্রতিবছর মামলা বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। মামলার জট কমাতে চট্টগ্রামে আরও দুটি অর্থ ঋণ আদালতের কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার নুরুন নবী জানান, চারশ কোটি টাকা ঋণ আদায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাদের ৫০টি মামলা চলমান আছে। ওই শাখার সবচেয়ে বড় ঋণ খেলাপী সালেহ গ্রুপ।
সালেহ গ্রুপের প্রধান প্রয়াত সালেহ আহমদ চৌধুরীর আত্মীয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘কোনো পেন্ডিং বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়। এটি আদালতের বিষয়।’’
যে কারণে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি
একাধিক আইনজীবী জানান, অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পর বিচারের শুরুতে স্বাক্ষীর পর্যায়ে যায়। বিবাদী উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করলে মামলাটি আটকে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে মামলা স্বাক্ষীর পর্যায়ে গেলে সেখানেও বিবাদী রিট পিটিশন দাখিল করে। এভাবে চলতে থাকে বছরের পর পর। মামলা নিষ্পত্তি হয় না।
মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার ক্ষেত্রে বাদী পক্ষের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও দায়ী করছেন অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে অনৈতিক সুবিধা নেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপী হয়ে গেলে নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করতে ব্যাংক কর্মকর্তারা মামলা পরিচালনায় আদালতে সঠিক তথ্য উপাত্ত এবং ডকুমেন্ট সরবরাহে অনাগ্রহ দেখায়।
ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সেলিম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, প্রথমত অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে মামলার বিবাদী পক্ষ অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে প্রভাব বিস্তার করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করতে মামলা পরিচালনায় অসহযোগীতা করে।
মামলা পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বাজেট স্বল্পতাও মামলা নিষ্পত্তিতে বাধা হিসেবে মনে করেন প্রফেসর ড. সেলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, অনেক সময় মামলা পরিচালনায় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। ওই অর্থ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে মামলা মাঝপথে ঝুলে থাকে।