বুড়িগঙ্গার পর ধলেশ্বরীতেও দূষণ ছড়াচ্ছে ট্যানারি বর্জ্য
বুড়িগঙ্গাকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে ২০১৭ সালে হাজারিবাগ থেকে সরিয়ে সাভারে ট্যানারি শিল্প এলাকা স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু, এই নতুন শিল্প এলাকাই এখন ধলেশ্বরী নদী দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্যানারি ভিত্তিক দূষণের প্রধান দুইটি কারণের একটি হল; কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না রাখা। দ্বিতীয় কারণটি হল; কাঁচা চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মাত্রাতিরিক্ত পানির ব্যবহার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রানুসারে, মাত্রাতিরিক্ত পানি ব্যবহার নগরীর সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের উপর বাড়তি চাপের সৃষ্টি করছে। ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায়, সিইটিপি ঠিকভাবে পানি শোধন করতে পারছে না। আর সেই অশোধিত পানি গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরীতে।
এছাড়া, কঠিন বর্জ্যগুলোর জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায়- সেগুলো খোলা জায়গায় পড়ে থাকছে। ছয় একরের ময়লা ফেলার একটি নির্ধারিত জায়গায় পশুর চামড়া ও পশম, খুর, কান, শিং, নখ, লেজ ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে ফেলা হচ্ছে। খোলা জায়গায় থাকায় বৃষ্টির পানিতে ধুঁয়ে সেই বর্জ্যগুলোই ধলেশ্বরীতে গিয়ে পড়ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি ট্যানারি শিল্প এলাকায় গেলে নির্মাণাধীন রাস্তাঘাট দেখতে পায়। এছাড়া, সড়কবাতি লাগানোর কাজও ছিল অসমাপ্ত। তবে সবথেকে বাজে অবস্থা ছিল ধলেশ্বরীর। বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীর পানিও এখন কালো বর্ণ ধারণ করেছে। সেই সাথে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ।
সিইটিপির চারটি মডিউলই ছিল ঘূর্ণায়মান। ট্যানারি থেকে বেরিয়ে আসা দূষিত তরল মডিউলে প্রবেশ করছিল। সেই পানি মডিউল থেকে পরিশোধনের পর বেরিয়ে ধলেশ্বরীতে গিয়ে পড়ছে।
আশেপাশের মানুষরা জানান, পুর্বে তারা দৈনন্দিন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতেন। কিন্তু, এখন আর তা সম্ভব না। দূষিত এই পানি ব্যবহারে চামড়ায় সমস্যা দেখা দেয় বলেও জানান তারা। স্থানীয় জেলেরা জানান নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন(বিসিক) ২০০৩ সালে হাজারিবাগ থেকে সকল ট্যানারি সরিয়ে পরিকল্পিত ট্যানারি শিল্প নগরীতে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। আজ ১৭ বছর পরেও প্রকল্পটি শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ চার দফায় বাড়ে। অন্যদিকে, বেশ কয়েক দফায় ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
বিসিক বলছে প্রকল্পটির মেয়াদ আর বাড়বে না। এবছর জুনের মধ্যেই সকল কাজ সম্পন্ন হবে।
সিইটিপি প্রতিবছর ২৫ হাজার ঘন মিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে। তবে ঈদ-ঊল-আজহার মতো সময়ে তরল বর্জ্যের পরিমাণ ৫০ হাজার ঘন মিটারও ছাড়িয়ে যায়।
জানা গেছে, প্রতি টন কাঁচা চামড়া সংশোধনের জন্য প্রায় ৩০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু, ট্যানারিগুলো ৫০ হাজার লিটারের বেশি পানি ব্যবহার করে থাকে। ফলস্বরূপ, সিইটিপি সঠিকভাবে তরল বর্জ্য শোধন করতে ব্যর্থ হয়।
ট্যানারি মালিকদের সাম্প্রতিক সভায় বাড়তি পানির ব্যবহারের উপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেয় বিসিক। তবে ট্যানারি মালিকেরা তাতে সম্মত হননি।
বিসিকের পরিচালক মোহাম্মদ মোশতাক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সিইটিপি ঠিকভাবেই কাজ করছে। তবে উৎপাদন কাজের চাঙ্গা মৌসুমে তরল বর্জ্যের প্রবাহ বেড়ে গেলে প্ল্যান্টের উপর চাপ পড়ে। ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় তখন বাড়তি বর্জ্য অপরিশোধিত থাকে।"
"আমরা নতুন সময়সীমার মধ্যেই কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। পুরো কাজ শেষ হলে ট্যানারিগুলোই সুবিধা পাবে," বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ দিদার-উল-আলম বলেন, "ট্যানারিগুলোর স্থানান্তর নদী দূষণ কমাতে পারেনি। আগে বর্জ্যগুলো বুড়িগঙ্গায় পড়ত, আর এখন ধলেশ্বরীকে বিষাক্ত করছে।"
"সিইটিপির মাধ্যমে বর্জ্য শোধনের চেষ্টা করা হলেও, নিঃসৃত বর্জ্যের তুলনায় এর ক্ষমতা অপর্যাপ্ত। ফলস্বরূপ; বর্জ্যগুলো মাটি ও পানি দূষিত করছে। যদি এখনই কোনো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে," বলেন তিনি।
চামড়া শিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্র নাথ পাল- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ট্যানারিগুলোকে যখন স্থানান্তরে বাধ্য করা হয় সিইটিপি তখন কেবল ৫০ শতাংশ কার্যকর ছিল। এখন সবগুলো মডিউল চললেও মাত্রাতিরিক্ত পানির ব্যবহারের কারণে প্ল্যান্টের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে।"
'ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বর্জ্য শোধন করতে হয় বলে মাঝেমধ্যে প্ল্যান্টটি ঠিকমতো কাজ করে না,' ব্যখ্যা করেন তিনি।
গোড়ায় গলদ:
২০০৩ সালে যখন ট্যানারি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পরবর্তীতে, ২০১২ সালে প্রকল্পটিতে সংশোধন আনা হয়। মূল প্রকল্পে তখন প্রায় ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সিইটিপি স্থাপনের পরিকল্পনা যুক্ত করা হয়।
জেএলইপিসিএল-ডিসিএল জেভি নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে ২০১২ সালের ১১ মার্চ সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। বিসিকের সূত্র অনুসারে প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ১৮ মাস। কিন্তু নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি সম্পাদনা এবং স্থিতিস্থাপকতার কথা বলে আরও ছয় মাস মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে দুই বছরের কথা থাকলেও, ছয় বছরেও প্রতিষ্ঠানটির কাজ সম্পন্ন হয়নি। সিইটিপির মূল চারটি মডিউল নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে গেলেও- অনলাইন মনিটরিং ব্যবস্থাপনার কাজ এখনো চলছে।
প্রকল্পটি গত বছর ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যেই সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে প্রকল্পটির মেয়াদ দশবারের বেশি বৃদ্ধি করা হলেও, কাজ শেষ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি এখন আরেকবার মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেছে।
মূল প্রকল্পের মেয়াদ চার দফায় বৃদ্ধি পায়:
ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য সরকার ২০০৩ সালে হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরী স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৯৯ একর জমি বরাদ্দ করে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) কার্যনির্বাহী পরিষদ ২০০৩ সালের আগস্টে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটির জন্য ১৭৫.৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জানুয়ারি ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
সেই থেকে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও চার দফায় বাড়ানো হয়। নতুন সময়সীমা জুন, ২০২১ পর্যন্ত ঠিক করা হয়েছে। এরমধ্যে, বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে ১,১০৫.৫৬ কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। তার মধ্যে, ২৬০ কোটি টাকা ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য, ৫২১.৩৫ কোটি টাকা সিইটিপির জন্য, ২৩৪.১৭ কোটি টাকা সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (এসটিপি) জন্য বরাদ্দ করা হয়।
শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালে ট্যানারি মালিকেরা নতুন জায়গায় যেতে বাধ্য হয়। হাজারিবাগের ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ১৫৪টি প্রতিষ্ঠান চামড়া শিল্প নগরীতে বাণিজ্যিক প্লটের বরাদ্দ পায়। এদের মধ্যে ১৩০টি এখন সচল।
বাকি ২৪টি প্রতিষ্ঠান আইনি সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কার্যক্রম শুরু করতে ব্যর্থ হয়। তবে ১০টি ট্যানারির কার্যক্রম শীঘ্রই শুরু হতে চলেছে।
সাভার ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্র সুজন হোসেইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কয়েক বছর আগেও আমরা নদীতে গোসল করতে আর মাছ ধরতে যেতাম। কিন্তু এখন নদীর ধারে যাওয়াও মুশকিল।"
নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষজন জানান, শীত আসলে নদীর রঙ পরিবর্তিত হয়ে কালো রঙ ধারণ করে।
আবুল ফজল নামের এক স্থানীয় বলেন, "নদী আগে এতো পরিষ্কার ছিল যে নিচের মাটি পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যেত। কিন্তু এখন পানি পুরো কালো হয়ে গেছে।"
জেলে বিনয় সাধক জানান, এখন প্রায়ই নদীতে মরা মাছ ভেসে ওঠে।
হাজারিবাগের ট্যানারিগুলোকে হাইকোর্ট স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়ার পর তাদের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বিসিকের সূত্র অনুযায়ী, ট্যানারি কারখানাগুলো যখন সাভারে চলে যায় তখনও প্রকল্প অসমাপ্ত। বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সেই সময় সিইটিপির মাত্র দুইটি মডিউল পূর্নাঙ্গভাবে সচল ছিল। ফলে তখন পরিবেশ দূষণও বৃদ্ধি পায়।
শর্ত মেনে চলে এধরনের চামড়া ফ্যাক্টরিকে যুক্তরাজ্যের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সার্টফিকেট প্রদান করে। বিদেশি ক্রেতারা চামড়া কেনার ক্ষেত্রে এই সার্টিফিকেটের সন্ধান করে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটি ১৬টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ এবং নিরীক্ষিত এই চার বিভাগে সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে।
বাংলাদেশে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট আছে। এদের মধ্যে এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটের আছে স্বর্ণ মানের সনদপত্র। অন্যদিকে, রিফ লেদার লিমিটেড এবং অস্টান লিমিটেড যথাক্রমে ব্রোঞ্জ এবং নিরীক্ষিত সনদপত্রের অধিকারী।
ট্যানারি মালিকরা যা বলছেন:
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মোহাম্মদ শাহীন আহামেদ বলেন, এখন পর্যন্ত ট্যানারি শিল্প এলাকার পেছনে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সবগুলো ট্যানারি কাজ শুরু করলে পরিমাণটি আট হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে।
কাঁচা চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণে মাত্রাতিরিক্ত পানির ব্যবহারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "প্রতি টনে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার লিটার পানি ব্যবহার করা মানসম্মত। তবে তা ৪৫ হাজার লিটার পর্যন্ত উঠতে পারে।"
সালমা ট্যানারির মালিক এবং ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, "স্থানান্তরের পূর্বে কোনো ট্যানারি মালিক ঋণখেলাপি ছিলেন না। কিন্তু ,২০১৭ সাল থেকে অধিকাংশ মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।"
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদারের চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন বলেন, "স্থানান্তরের পর রপ্তানিকারকেরা কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে না।"
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, "১৫৫টি ট্যানারির বর্জ্য নিষ্কাশনের মতো ধারণক্ষমতা সাভারের সিইটিপির নেই।"
রিসার্চ এন্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর মুহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, "আমরা এখন পর্যন্ত বিশ্বমানের কিংবা পরিবেশ-উপযোগী শিল্পে পরিণত হতে পারিনি। কিন্তু আমাদের সে পর্যায়ে উঠতে হবে। আমাদের এখন 'নিয়ম নেই, তো ব্যবসা নেই' নীতি অনুসরণ করা দরকার।"