বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক ৩৫০ বিঘা সম্পত্তি আজও বেদখল
জীবনের পুরোটা অংশ নারী জাগরণের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর এলেই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। দিবস পালন করতে তার জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের বসতভিটা পরিষ্কার করে রঙ করা হয়। দিবস পালন শেষে আবারও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে সেই বাড়ি। এমনকি পৈত্রিক ৩৫০ বিঘা জমি এখনও বেদখল হয়ে পড়ে রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি পুকুর রয়েছে। এ জমিগুলো দখল করেছেন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
সেই নারীর স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাওয়া সেই মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিন আজ। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালের একই দিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাঙালি নারী আন্দোলনের অগ্রদূত ও সমাজ সংস্কারক এই নারীর আজ ১৩৯তম জন্মদিন ও ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাহিকসূত্রে নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বেশিরভাগ মানুষ তাকে বেগম রোকেয়া নামেই চেনে।
বেগম রোকেয়ার কিছু জমিতেই ইতোমধ্যে ঘর-বাড়িসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মামলা হয়েছে জমির ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু এখনও জমি ফিরে পাওয়া যায়নি।
হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল ২০১২ সালের ২২ ফেব্রয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট দাখিল করেন। এ রিটের ফলে স্মৃতি কেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে কেন্দ্রটির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সেখানে চলা শ্রমিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেন আদালত। ফলে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন হাইকোর্টের এ নির্দেশে ২০১২ সালের ১ মে উক্ত বিকেএমই’কে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে। শ্রমিক প্রশিক্ষণ বন্ধ করা হলেও যে উদ্দেশ্য নিয়ে স্মৃতিকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে আজও তার প্রতিফলন ঘটেনি।
পায়রাবন্দ স্মৃতি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, বেদখল হওয়া সাড়ে তিনশ বিঘা জমি পায়রাবন্দের প্রভাবশালী আবদুর রব চৌধুরীর ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী, আলমগীর চৌধুরী, একই গ্রামের মতিয়ার রহমান, চেংন্টু সর্দ্দার ও আছের আলীসহ অনেকে ভোগ দখল করে আসছেন। এখনও রোকেয়ার জমি ফিরে পাওয়া যায়নি।
তবে অভিযুক্তরা জানান, তাদের পুর্বপুরুষরা এসব জমি দখল করে চাষাবাদ করছেন। তবে তারা মামলার কথা স্বীকার করে জানান, এগুলো সরকারের জমি নয়। দীর্ঘদিন ধরে তারা এসব জমিতে আবাদ করছেন। সেখানে ইতোমধ্যে বাড়িসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের আশা, আদালতের মামলা রায় তাদের পক্ষে আসবে। এখন আদালতের আদেশের অপেক্ষায় রোকেয়ার জমি।
রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষার্থে সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিলেও বর্তমানে তা অবকাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখনও কোনো প্রকল্পেরই পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।
বছর ঘুরে রোকেয়া দিবস আসলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে পালন করা হয় ৯ ডিসেম্বর। দিবসটি গেলেই আবারও অযত্নে ও অবহেলায় পরে থাকে পুরো প্রকল্প। আশার কথা, বিগত তিন বছর ধরে এখানে বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত ও নাচের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। স্মৃতি কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারা জোরদার করা হয়েছে।
২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দিনের নির্দেশে এ কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই বছরের ১৭ মার্চ কেন্দ্রটি অলিখিতভাবে বিকেএমই’র শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। শুরু হয় শ্রমিকদের পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ। আর এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনা প্রধান মঈন-ইউ-আহমদ। ফলে প্রকল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নসহ মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে থাকে।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তার মৃত্যু ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কলকাতার সোদপুরে। জন্ম-মৃত্যুর ব্যবধানে কেটে গেছে প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময়। এ সময়ের মধ্যে বিলীন হয়েছে জমিদার পিতার বসতভিটা, জায়গা জমি গেছে অন্যের দখলে। স্মৃতিচিহ্ন বলতে রয়েছে তার পৈত্রিক বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ও মূল ফটক। সেটিও অযত্ন আর অবহেলায় দাঁড়িয়ে থেকেছে কয়েক যুগ।
রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাড়ে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৩ একর ৪৫ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অথচ বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক সম্পত্তিই ছিল সাড়ে তিনশ’ বিঘা, যা বিভিন্ন জনের কাছে ভোগদখলে রয়েছে। জমি অধিগ্রহণের পর পরই গ্রহণ করা হয় বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সর্ম্পকে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলীর অনুবাদ, প্রকাশনা ও বহুল প্রচার, সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র নির্মাণ এবং স্থানীয় যুবক-যুবতীদেরকে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান প্রকল্পসহ মান সম্মত অডিটরিয়াম, সেমিনার কক্ষ, রেস্টহাউস, লাইব্রেরি,পাঠাগার ও সংগ্রহশালা নির্মাণ এবং নামাজ ঘর ও স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণসহ নানা প্রকল্প। এ ছাড়াও হাতে নেয়া হয় স্মৃতিকেন্দ্র চত্বরে দৃষ্টি নন্দন পিতলের তৈরি বেগম রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্প।
অপরদিকে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ স্মৃতি কেন্দ্রটি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করে এ পায়রাবন্দকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি পাদপীঠ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এরপর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় এ কেন্দ্রটি ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করে। তখন থেকে প্রতি বছরের ৯ ডিসেম্বর নানা আয়োজনের মধ্যে বেগম রোকেয়ার জন্ম দিবসটি ঘটা করে পালন করা হয়। তিনদিন ব্যাপী মেলা, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাটলেও অন্যান্য দিনগুলো থাকে উপেক্ষিত। সিময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেস্তে গেছে অন্য সব প্রকল্প। কেন্দ্রটি উদ্বোধনের দীর্ঘ পনের বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রকল্পেরই পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি।
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য একটি মামলা মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা আশা করছি মামলার রায় স্মৃতি কেন্দ্রের পক্ষেই আসবে। রায় এলে বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।