বেগম রোকেয়ার 'সুলতানাস ড্রিম’ স্প্যানিশ অ্যানিমেশন, স্যান সেবাস্তিয়ানে
বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বই 'সুলতানার স্বপ্ন' অবলম্বনে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা তৈরি করেছেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। স্প্যানিশ ভাষায় সিনেমাটির নাম রাখা হয়েছে 'এল সুয়েনো দে লা সুলতানা'—ইংরেজিতে 'সুলতানাস ড্রিম'।
স্পেনের ৭১তম স্যান সেবাস্তিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শন হচ্ছে নারীবাদী ছবিটি। এটি যেমন ইসাবেল হারগুয়েরার প্রথম ফিচার ফিল্ম, সেইসঙ্গে এ উৎসবে নির্বাচিত হওয়া প্রথম অ্যানিমেশন ফিচার ফিল্মও।
এ ছবির গল্পে এমন এক দুনিয়ার কথা উঠে এসেছে যেখানকার শাসক নারীরা। পুরুষরা সেখানে কমজোর। সেই দুনিয়ার নাম 'লেডিল্যান্ড'। আর এই 'লেডিল্যান্ড' আঁকতে ব্যবহার করা হয়েছে 'মেহেদি' টেকনিক। 'সুলতানাস ড্রিম' আঁকা হয়েছে দ্বিমাত্রিক কালি ও জলরঙে।
এ প্রজেক্টের সূত্রপাত ২০১২ সালে ক্রাউডফান্ডিং বা গণঅর্থায়ন জোগাড়ের প্রচেষ্টার মাধ্যমে। বেগম রোকেয়ার 'সুলতানাস ড্রিম' নিয়ে বেশ কয়েকটি সফল কর্মশালার আয়োজন করেন সিনেমাটির নির্মাতারা। চিত্রনাট্য প্রস্তুত করার জন্য অনুদানও পেয়ে যান বাস্ক সরকারের কাছ থেকে। অ্যানিমেশন ছবিটির চিত্রাঙ্কনের অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে বেগম রোকেয়ার বইয়ের ইউটোপিয়ান ন্যারেটিভ থেকে।
ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ইনেস এক চলচ্চিত্র নির্মাতা। সে ভারত সফরে বের হয়। এ সফরে সে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিচিহ্ন এবং মিথের 'লেডিল্যান্ড' খুঁজে বেড়ায়। এক দশকব্যাপী এই প্রজেক্ট চলচ্চিত্রটির নির্মাতার নারীবাদী জ্ঞানকে ঋদ্ধ করেছে, কাঠামো দিয়েছে।
ছবিটির নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরার সঙ্গে কথা বলেছে ভ্যারাইটি।
প্রশ্ন: শর্ট ফিল্ম থেকে ফিচার ফিল্ম পরিচালনায় এলেন। এই রূপান্তরের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল? ফিচারে তো অনেক অ্যানিমেশন টেকনিক ব্যবহার করা হয়।
উত্তর: সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল একটা সিস্টেম বা পদ্ধতি বের করা, যার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটা ভাগাভাগি করে নেয়া যায়। অন্য মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা জরুরি ছিল—এবং আমি অন্যদের মেধার ওপর বিশ্বাস রাখি। ছোট প্রজেক্টে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে, শর্ট ফিল্মে আমি এমনটাই দেখে এসেছি। কেউ কেউ বলে, শর্ট ফিল্ম থেকে ফিচারে যাওয়ার পথে যে রূপান্তরটা হয়, তা খুব একটা সুখকর নয়। কিন্তু কথাটা সত্যি না। আমার কাছে এই রূপান্তরটাকে ১০ গুণ জটিল মনে হয়েছে। বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে। আমাদের পাইপলাইন তৈরি করতে হয়েছে, কারণ আমরা তিনটি আলাদা টেকনিক ব্যবহার করেছি—প্রতিটি টেকনিকই স্বকীয়। ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমরা শুরু করেছি ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে, যাতে দৃশ্যের আবহ ঠিক করে নেয়া যায়। সবার শেষে করেছি চরিত্রগুলোর অভিনয়ের কাজ। এতে উপকারই হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা শিল্পীসুলভ পদ্ধতিটা শক্তিশালী করে অ্যানিমেশন প্রোডাকশন কমাতে পেরেছি, যা কিনা প্রোডাকশনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ কাজ।
প্রশ্ন: এই ছবির প্রতিটি পর্বেই অনন্য আলো ও আবহ রয়েছে। আপনি তো আসল জায়গায় (ভারতে) ভ্রমণ করেছেন, আপনার স্কেচবই সঙ্গে নিয়েই। সেটি কি এই উৎকর্ষ অর্জনে সাহায্য করেছে?
উত্তর: হ্যাঁ, আমি নিয়মিত নানা জায়গায় ঘুরতে যেতাম, স্কেচ করতাম। সহজাত প্রবৃত্তির বশে ওইসব জায়গার নির্যাস উঠে এসেছে আঁকায়। …আঁকাআঁকির মাধ্যমে আমরা অনেককিছুই প্রকাশ করতে পারি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই ফিল্ম তৈরিতে শিল্পীসুলভ পদ্ধতি অবলম্বনের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। বড় স্ট্রোক দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে সেগুলোকে নিখুঁত করেছি। তবে পেইন্টিং নিয়ে কাজ করার মতোই…এখানেও কখনও থামতে হয়, তা জানা জরুরি।
প্রশ্ন: ২০১৩ সালে আপনি একটি নারীদের সমবায় সমিতিতে কাজ করেছেন। ওই কাজ আপনার চূড়ান্ত ছবির কাজের ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে?
উত্তর: ২০১২ সালে আমি এসইডব্লিউএ-র (সেলফ এমপ্লয়েড উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে প্রথম কর্মশালার আয়োজন করি। ওই সময়ই প্রথম বইটির খোঁজ পাই। পরে আমরা আরও অনেকগুলো কর্মশালার আয়োজন করি। সর্বশেষ কর্মশালাটি হয় ২০১৯ সালে, মহামারির ঠিক আগে আগে। ওই বছর আমি সর্বশেষ ভারত সফর করি, একটা কর্মশালা করি কলকাতায়। পরে ভারতীয় শিল্পী রাজিব আইপি ব্যাঙ্গালোরুতে একটি কর্মশালার আয়োজন করেন। সবশেষে আমাদের ভারতীয় টিম (ব্ল্যাকবার্ড ডিজাইন) মুম্বাইয়ে আরেকটি কর্মশালার আয়োজন করে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সমস্ত উপাদানই মেহেদি শিল্পীরা এঁকেছেন। আর অ্যানিমেশনের কাজ ও চূড়ান্ত ছবি আঁকার কাজটি করেছে ব্ল্যাকবার্ড ডিজাইন।
প্রশ্ন: বেগম রোকেয়ার মূল বই 'সুলতানাস ড্রিম'-এর কোন কোন জিনিসগুলো আজকের দর্শকদের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে হয় আপনার কাছে?
উত্তর: প্রথম বইটি পড়ার সময় আমি মূলত ভারতের তরুণী ও নারীদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করতাম। এই নারীদের কেউ কেউ ইংরেজিতে কথা বলতেন, অন্যরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতেন। ওসব ভাষা আমি বুঝতাম না। তবে স্পেন বা ভারত যেখানেই থাকি না কেন, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সর্বত্রই দেখেছি। এ ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। রোকেয়া কীভাবে এমন এক দুনিয়া তৈরির কথা ভাবলেন, যেখানে নারীরা নিরাপদ বোধ করবে...ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। …তার এ কাজের অন্তর্নিহিত অর্থ একটাই: নিরাপত্তার জন্য ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা। এসব কর্মশালায় মেয়েদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ওরা পুরুষ হলে কী করত। তখন একটা উত্তর সবসময় পেতাম: 'সূর্য ডোবার পর আমি নির্ভয়ে বাইরে যেতে চাই।' এই অনুভূতিটা সর্বজনীন। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, অল্পবয়সি মেয়েরা, যাদের বয়স তিন থেকে সাত বছর, তারা অনেক বেশি সাহসী ছিল। ওরা নিজেদের কল্পনা নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করে ফেলত—পুরুষদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারত স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ নারীদের কাছ থেকে কী আশা করা, তা বুঝে যেত ওরা। এতে ওরা প্রায় সবাই খোলসবন্দি হয়ে পড়ত, নিজেকে গুটিয়ে নিত।