ভারতের চোখে শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশি একটি সংবাদপত্রে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে ঠিক অর্ধ শতক আগে, যখন আমি ছিলাম এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ ছাত্র যে কিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঢুকে পড়েছিল। সত্যিকার অর্থে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসায় আমার কোনো আত্মীয় ছিলনা এখানে কিন্তু পূর্ববঙ্গে তখনো কিছু ভালো যোগাযোগ ছিল। আমার নানা ছিলেন খুব সম্ভবত ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সিভিল সার্জন এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট। পরবর্তীতে নানাকে যশোর এবং নদীয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট করে পাঠানো হয় সেসময়ের কুখ্যাত ১৯৪৩ সনের দুর্ভিক্ষ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে। একই বছরে আমার ভাইও মাদারিপুরের এসডিও হয়ে আসেন। এই চাকরিই ভাইকে মুজিব শতবর্ষের মূল কেন্দ্র টুঙ্গিপাড়া পর্যন্তও নিয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা বোধহয় কাকতালীয়র চাইতেও বেশি অদ্ভুত যে ১৯৮১ সালে আমি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত হলাম। চার বছরেরও বেশি সময় আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির আশেপাশে থেকেছি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ১৯৯২ সালে অবসরে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশের সাথে সরাসরি যুক্ত কিছু কাজে আমি জড়িত ছিলাম। আর সে কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যেন একরকম অবধারিত এবং ভাগ্যে লিখাই ছিল।
ফিরে যাই ১৯৭১ সালে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ছোট কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত, আলোকিত একটা শহর এলাহাবাদ। মুক্তিযুক্ত হয়ছিল বাংলাদেশে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই নয়-দশ মাস ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যেন ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই উত্তাপ। বিশেষত ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের সামনে সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান নামের এক মহানায়কের নাম ছিল ভারতীয়দের মুখে মুখে। সেই ভাষণ প্রচারিত হয়েছিল এয়ার কলকাতায়, যদিও তা বাংলায়ই ছিল কিন্তু এই ভাষণ শুনেছিল হাজার হাজার মানুষ। 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম' এর মত নির্ভয়বাক্য ছুঁয়ে গিয়েছিল ভারতের সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের হৃদয়।
ভারতীয়দের একটা সহজাত প্রবৃত্তিই ছিল হিরো বা সাহসী নায়কদের সবচেয়ে উচ্চ আসনে রাখার। শেখ মুজিব যখন তার বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করলেন, "তোমাদের কাছে যা যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিবো" তা ভারতীয়দের যেন একটা জাদুর মত মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো। তারা শেখ মুজিবের নিরাপত্তা আর সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করতে শুরু করলো। আর পাকিস্তানিদের অভিশাপ দিতে লাগলো তাদের নৃশংসতার জন্যে।
বাংলা রেডিও কমেন্টেটর দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায় রেডিওতে এতবার মুজিবের ভাষণ প্রচার করতেন যে তখন বহু ভারতীয় পরিবার নতুন ট্রানজিস্টর রেডিও এবং ব্যাটারি কিনতো শুধু শেখ মুজিবের ভাষণ শুনতে। মুজিব ছিলেন ভারতের সব জায়গায়। আর এটাই ছিল মুজিবের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা যে তিনি তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে ভারতীয়দের মনে বড় দাগ কেটে রেখে গেছেন।
যখন জানা গেল যে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানিরা বন্দী করে রাওয়ালপিন্ডির মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে গেছে, তখন ভারতে একতা বিষাদের ছায়া পড়ে গেল। এরকম খুব খুব কম শোনা যায় যে ভিনদেশী এক নেতার গ্রেপ্তার হবার খবরে অন্য দেশে এতটা দুঃখ আর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচার থেকে যেন বঙ্গবন্ধু রেহাই পান তার জন্যে প্রার্থনা করা হতো। ভারতের এই উদ্বিগ্নতা ছিল চোখে পড়ার মত। সব বাংলাদেশির মত ভারতীয়রাও ভয় পাচ্ছিলো যে শেখ মুজিবকে কি মেরেই ফেলা হবে কিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবের মুক্তির মধ্য দিয়ে অশুভ ছায়া কেটে গেলো। আর এই সময়ের মধ্যে অনেক জল গড়িয়ে গেছে আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হয়েছে এক স্বাধীন দেশ, স্বাধীন রাষ্ট্র ।
ভারতের অন্যান্য জায়গার মত এলাহাবাদেও হয়েছিল নানা বিজয় মিছিল। আমরা তরুণ ছাত্ররা রাস্তায় চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছিলাম 'জয় বাংলা, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ!" ভারতের তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা ছিল একটা নতুন ঐতিহাসিক আরম্ভ। এই তরুণদের কাছে শেখ মুজিব ছিলেন এক অচেনা নায়ক। তিনি কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা কিংবা ভিয়েতনামের হো চি মিন এর সমপর্যায়ে নন্দিত হয়ে উঠেছিলেন। শেখ মুজিব ভাষার সীমারেখাকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন, আর আমি লক্ষ্য করেছিলাম কিভাবে ভারতের হিন্দি ভাষাভাষীদের মধ্যেও তার গুণ ও পারদর্শীতার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ছাড়া পাবার খবর পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ব্রিটিশ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ইন্দিরা গান্ধী তখন মুজিবকে একটি ব্রিটিশ বিমানে করে প্রথমে দিল্লিতে আনার ব্যবস্থা করেন। ভারতের রাজধানীতে বিরতি দিয়ে তারপরেই বাঙালির এই নেতা ঢাকায় উড়ে আসেন। এর আগে মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে ছাড়া পাবার সাথে সাথেই একটি পাকিস্তানি বিমানে করে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধীর এই শক্ত পদক্ষেপই আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আর সুদৃঢ় হতে যাচ্ছে।
মুজিব যখন নয়াদিল্লীতে থেমে তারপর বাংলাদেশে এলেন, সেই দিনটা ছিল অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনাপূর্ণ একটা দিন। ভারত সরকারের প্রায় সবাই সেদিন বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিল আর দর্শনার্থীর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। এতগুলো বছর পরেও এখনো ভারতীয়দের মনে শেখ মুজিবের জন্য রয়েছে একটা অন্যরকম স্থান। পাকিস্তানের পরাজয় ভারতীয়দের স্বস্তি দিয়েছিল এবং শেখ মুজিবের হাতে নতুন বাংলাদেশ অবশ্যই ভারতের দিকে বন্ধুভাবাপন্ন হাত বাড়িয়ে দিবে বলেই তারা মনে করেছিল।
ঢাকায় ফিরে মুজিব সরকারের দায়িত্ব হাতে নিলেন এবং জোরেশোরে দেশকে গুছিয়ে তোলার কাজ শুরু করলেন। ভারতের সাথে তার এমন একটা হৃদ্যতা ছিল যা ইতিহাসে বিরল। সীমান্তচুক্তি এবং অন্যান্য নানা চুক্তি সম্পন্ন হচ্ছিলো তখন। ভারতের ভৌগলিক সুবিধা দেখতে গিয়ে মুজিব কোনোদিনই স্বাধীন বাংলাদেশের সুবিধাকে ছাড় দেননি। একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এটিই ছিল তার অবস্থান।
কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকেরা। আর সেই সাথে ইন্দো-বাংলা বন্ধুত্বেরও একটা বর ক্ষতি হয়ে যায়। ঘাতকেরা ভারতবিরোধী ও বাংলাদেশবিরোধী বিশাল নীলনকশা এঁকেছিল। মুজিবকে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো বারবার তার বিরুদ্ধে চলতে থাকা এসব ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছিল। কিন্তু মুজিব নিজের জনগণকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে তিনি এসব সতর্কবাণী কানে তোলেননি যা শেষ পর্যন্ত তার জন্যে করুণ পরিণতি বয়ে আনে।
ভারতীয়রা শেখ মুজিবের এই নৃশংস হত্যাকান্ড মেনে নিতে পারেনি। তিনি সকলেরই ভীষণ প্রিয় ছিলেন। মানুষ তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো। সমগ্র ভারত তখন মুজিবকে হারানোর শোকে ছিল এবং আজ মুজিবকে হারানোর ৪৫ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও মুজিব এখনো বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে। মানুষ আজও তার কথা স্মরণ করে। আমাদের সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ইন্দো-বাংলা সম্পর্ককে আরো মজবুত করতে। শেখ মুজিব যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কারিগর ছিলেন তা তার জন্মশতবার্ষিকীতে এসে আরো উজ্জ্বল হয়েছে। সেই সাথে আজকের দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ৫০ বছর পূরণ করলো যেখানে ভারতের ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
- শান্তনু মুখার্জী ঢাকা অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
- মূল লেখা: Sheikh Mujibur Rahman, from an Indian perspective
- অনুবাদ: খুশনুর বাশার জয়া