ভারতের সাথে সংযুক্তির উদ্যোগে নেপাল ও ভুটানকে পাশে রাখবে বাংলাদেশ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরে দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে আলোচনার বিষয় হিসেবে কানেক্টিভিটিই শীর্ষে থাকবে। বাংলাদেশ কানেক্টিভিটিকে দু'দেশের মধ্যে সীমিত না রেখে নেপাল ও ভুটানকে যুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেবে। আর ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ডের পাশাপাশি সমুদ্রপথে নিজেদের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্তির বিষয়টি আলোচনায় রাখবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে। সূত্রগুলো বলছে, বঙ্গেপসাগরকে ঘিরে যুক্ততার যে উদ্যোগ তাও ভারতের দিক থেকে তোলা হতে পারে।
২৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় সংযুক্তি, ব্যবসার পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোও প্রাধান্য পাবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীতে দু'দেশের সম্পর্কের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেনা-পাওনার হিসেবে এতে বড় অর্জন সমুদ্রসীমা ও স্থল সীমান্ত চুক্তি। তবে এখনও তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সেভাবে এগোনো যায়নি। বাণিজ্য বৈষম্যেও দূরত্ব কমেনি । রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতকে পাশে পাওয়ার বিষয়টিও প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি।
সূত্র বলছে, দুই দেশের আলোচনায় পানিসম্পদ বণ্টনের বিষয়টিও যথারীতি গুরুত্ব পাবে। এবারের সফরে তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি হবে না, সেটা আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। তারপরও বাংলাদেশ বিষয়টি আলোচনায় তুলবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশকে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেইটওয়ে তথা মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি হাবে রূপান্তর করতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে দুই দেশের বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় নেপালকে দেশের নৌপথ ও ভূখণ্ড ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করতে দিতে চায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটানেও পণ্য পরিবহন করতে চায়।
বাংলাদেশ এর মধ্যেই সড়ক ও রেলপথে নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঁচটি রুটে পণ্যবাহী যান চলাচলের অনুরোধ জানিয়েছে ভারতকে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে বিষয়টি তুলে তা দ্রুত বাস্তবায়নের অনুরোধ জানাতে পারে বাংলাদেশ। সড়কপথে নেপালের জন্য মেছিনগর, বিরাটনগর, বীরগঞ্জ ও রেলপথে রোহানপুর-সিংহাবাদে যোগাযোগ স্থাপনের যে অনুমতির অনুরোধ জানিয়েছে তাও আলোচনায় আসতে পারে। ভুটানের সঙ্গে রেলপথে চিলাহাটি-হলদিবাড়ীতে যুক্ত হতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, "নেপাল ও ভুটান উভয়ে ল্যান্ডলকড কান্ট্রি হওয়ায় ভারতের সহযোগিতা ছাড়া তাদের সঙ্গে কানেক্টিভিটি কঠিন। এজন্য তাদের সরকারপ্রধানরাও চান বাংলাদেশ যাতে এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযাগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে"।
"চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেলপথে ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে কার্গো পরিবহন শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসলে এ রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে। চিলাহাটি থেকে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ভারতের সম্মতি লাগবে, কারণ কিছু অংশ ভারতে পড়েছে। মোদীর সফরে বাংলাদেশ এ বিষয়টি উত্থাপন করবে,"মোমেন বলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই দিনের সফরে আজ শুক্রবার ঢাকা আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
মোদীকে বিমানবন্দরে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। এরপর তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। একই দিন বিকালে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত অনুষ্ঠানে 'গেস্ট অব অনার' হিসাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনী পরিদর্শন করবেন।
সফরের দ্বিতীয় দিন, শনিবার সকালে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ পরিদর্শন করে শ্রদ্ধা জানাবেন। তাছাড়া, তিনি সাতক্ষীরা এবং গোপালগঞ্জে দুটি মন্দির পরিদর্শন করে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মতবিনিময় কথা রয়েছে। ওইদিন বিকেলে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠক ছাড়াও প্রতিনিধি পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হবে।
দুই প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে নিজ নিজ দেশের পক্ষে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পৃথক দুটি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করবেন। এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সফরশেষে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২৭ মার্চ রাতে দিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন।
এ ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী শিলাইদহের সংস্কারকৃত কুঠিবাড়ি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি সমাধি, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু, তিনটি সীমান্ত হাট উদ্বোধন করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের কাছে ভারতের ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্সও হস্তান্তর করবেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে অন্তত ৬টি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এর মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সমঝোতা হওয়ার কথা আছে। সমুদ্রে মৎস্য আহরণের ব্যাপারে সহযোগিতা, পরিবেশগত সুরক্ষায় সহযোগিতা এবং দুই দেশের ন্যাশনাল স্টাফ কলেজের মধ্যে সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতাসহ কয়েকটি সমঝোতা হতে পারে।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর বাণিজ্য ক্ষেত্রে সুবিধার ধরন কী হবে তা নিয়ে 'কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট' (সেপা) চুক্তির প্রস্তাব করেছে ভারত। বর্তমানে বাংলাদেশ সাফটা চুক্তির আওতায় ভারতের কাছ থেকে বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়ন ঘটলে সেই সুবিধার ধরনে কী হবে সে ব্যাপারে একটি যৌথ স্টাডির বিষয় যৌথ ঘোষণায় থাকতে পারে। অভিন্ন নদীগুলোর পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই নেতার নির্দেশনা যৌথ ঘোষণায় থাকতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, "একটি উৎসবে যোগ দিতে বাংলাদেশে এলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দ্বিপাক্ষিক অনেক বিষয়ই আসবে, আলোচনা হবে দিক নির্দেশনা আসবে। এটাকে মাল্টিপারপাসলি কতটা কাজে লাগাতে পারব তার ওপরই আমাদের সাফল্য নির্ভর করবে"।
তিনি বলেন, "তিস্তা ইস্যু নিয়ে যে কিছু হবে না সেটা আমরা জানি। ব্যবসা, কানেক্টিভিটি, বিনিয়োগ নানা বিষয় আলোচনা হবে। কিন্তু আলোচনা, সিদ্ধান্ত এবং শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন এবং কার্যকারিতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থানের ওপর আমরা কতটা প্রভাব ফেলতে পারি সেটার ওপরও অনেকের নজর থাকবে। তবে কূটনীতি যেহেতু গতিশীল একটি বিষয় সেক্ষেত্রে গঠনমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে"।