ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাত
এইচ এম এ বারিক, কখনও বাদল হাওলাদার আবার কখনও মোস্তাক আহমেদ। পাসপোর্ট ব্যবহার করেন আবু সাঈদ সুমন নাম দিয়ে। পরিচয় দেন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে। চড়েন দামি গাড়িতে। এসব নাম পরিচয় ব্যবহার করে ভুয়া সঞ্চয়পত্র ব্যাংকে জমা রেখে মোটা অংকের টাকা লোন হাতিয়ে নেন তিনি। শুধুমাত্র এবি ও ট্রাস্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোন নিয়ে আত্মসাত করেছেন বারিক ও তার স্ত্রী মুরশিদা আফরীন।
ব্যাংক থেকে আত্মসাত করা টাকায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-২ নম্বর এলাকায় গড়ে তুলেছেন ৯ তলা আলিশান বাড়ি। যার বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া উত্তরায় রয়েছে ৬ তলা ও উত্তরখানে রয়েছে ২ তলা বাড়ি। তিনটি বাড়ির বাইরে নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি ও জমি। ছিল পল্টন এলাকার পলওয়েল মার্কেটের পাশে রিকন্ডিশনাল গাড়ির শো-রুম।
ভুয়া সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা ২০০৪, ২০১১ ও ২০১৬ সালের করা চারটি মামলা তদন্ত নেমে এসব চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে ২১টি ব্যাংক লোনের মাধ্যমে ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত ৭ জানুয়ারি খুলনা মহানগরীর খালিশপুর থানা এলাকা থেকে এই দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর দু’দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
এর আগে ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে ব্যাংক লোন নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করেছে বাংলাদেশ ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট। তদন্তে এই সংস্থাটি প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা।
সিআইডির অনুসন্ধানে, এই চক্রের মূলহোতা এক শিল্পপতির নামসহ ২১ সদস্যের একটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ বাকি সদস্যদের গ্রেফতার ও মামলা তদন্তের স্বার্থে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ।
মামলার তদন্ত তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভুয়া সঞ্চয়পত্রের দিয়ে এবি ব্যাংক থেকে মোটা অংকের লোন পেতে এই চক্রকে সহায়তা করতো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে লোন নেয়ার ঘটনায় ২০০৪ সালে এবি ব্যাংক বাদি হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় এবি ব্যাংক ধানমন্ডি ব্যাঞ্চের তৎকালীন ব্যবস্থাপক আসিরুল হক ২০০৬ সালে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিন মাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়ে ওই বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। এই ঘটনায় ব্যাংক ক্রেডিট অফিসার মঈনুল হোসেনকেও গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারকৃত বারিক দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও মালয়েশিয়ায় পলাতক ছিল। সম্প্রতি দেশে ফিরলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, চক্রের মূলহোতা ভুয়া সঞ্চয়পত্র বানিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে লোন পেতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দিত। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা এসব সঞ্চয়পত্র যাচাই-বাচাইয়ের নামে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিয়ে লোন পেতে সহায়তা করতো। এসব সহায়তা করে প্রতারক চক্রের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিত ওইসব কর্মকর্তারা।
এসব সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে নেওয়া ব্যাংক লোন পরিশোধ না হওয়ায়, সঞ্চয়পত্রে জমা দেওয়া নাম-ঠিকানা ধরে ওই ব্যক্তির সন্ধানে নামতো ব্যাংক। সন্ধানে নেমে ব্যাংক বুঝতে পারতো ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে মোটা অংকের লোন নিয়েছে প্রতারক চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে আমেরিকান থেকে ফিরে এসে এক ব্যক্তি এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলে। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল এবি ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপক আসিরুল হক। এছাড়া জনৈক ওই ব্যক্তির তিন বন্ধুসহ মোট ২১ জনের এই সিন্ডিকেট এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। চক্রের মূলহোতার খুলনা, গাড়ীপুর ও ঢাকায় ব্যবসা রয়েছে। মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ রয়েছে শেয়ার বাজারও।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, চক্রের মূলহোতা এভাবে ব্যাংক লোন নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে আমেরিকাতে পাঠান। সেখান থেকে বৈধ চ্যানেলে আবার দেশে টাকা ফিরতে এনে গড়ে তুলেন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান।
ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে ব্যাংক লোন নিয়ে টাকা আত্মসাত করার ঘটনায় দুদক গ্রেফতারকৃত বারিক ও তার স্ত্রী বিরুদ্ধে গুলশান, ধানমন্ডি, উত্তরা পশ্চিম ও মোহাম্মদপুর থানায় সাতটি মামলা দায়ের করেন। ধানমন্ডি থানার মামলার এজহারে উল্লেখ রয়েছে, পিরোজপুরের পারেরহাট থানার আব্দুল হামিদ হাওলাদারের ছেলে আবু সাঈদ সুমন অসৎ উদ্দেশ্যে, প্রতারণার মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স, জাতীয়তা / চারিত্রিক সনদপত্র এবং আয়কর অফিসের প্রত্যয়নপত্রে বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ট্রাস্ট ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০০৪ তারিখে মেসার্স সুমন এন্টারপ্রাইজের হিসেব নং ৩৬০০০০৪২ খুলে ২৫ মে মাত্র চার মাসে দুই দফায় চার কোটি ২৬ লাখ ৩৩ লাখ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন এবং আত্মগোপন করেন।
মামলার এজহারে আরও উল্লেখ রয়েছে, দুদকের অনুসন্ধানে আসামি জাল সঞ্চয়পত্র বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দিয়ে এবং ভুয়া এফডিআরের বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক হতে বিভিন্ন অংকের টাকা লোন নিয়ে আত্মসাত করেছে।
এছাড়া দুদকের গুলশান থানা মামলার এজহারে উল্লেখ রয়েছে, একই কায়দায় ব্রাংক ব্যাংকের গুলশান শাখায় যৌথ হিসাব নং ১৫০১৮০০৮০৭৬৩ যা পরবর্তী হিসাব নং ১৫০১১০০০৩১৮৪৯০০১ খুলে যৌথ নামে সাতটি এফডিআর এবং মুরশীদা আফরীনের নামে চারটি ৯ কোটি টাকার এফডিআর হিসাব খুলে এক কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার আত্মসাত করে।
মামলার অন্যান্য এজহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৭ ও ২০১৪ সালে একই কায়দায় কোটি কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে আত্মসাত করেছেন।
ভুয়া সঞ্চয়পত্র ব্যাংক লোন করে টাকা আত্মসাত প্রসঙ্গে এবি ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ঘটনাগুলো আমি যোগদানের অনেক আগের। আগে এ ধরনের ভুয়া সঞ্চয়পত্র দিয়ে লোন উত্তোলনের কথা শুনেছি। সম্ভবতা এসব প্রতারণার অভিযোগে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ব্যাংক লোন বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংক।