মটকার উপর দাঁড়িয়েছিল ৩০০ বছরের পুরনো ভবন!
প্রথম দেখাতেই যে কারো মনে হতে পারে সারি সারি 'মটকা'য় (এক ধরনের কলস) মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে গুপ্তধন। আসলে ওই মটকাগুলোর উপরই গত তিনশ বছর দাঁড়িয়েছিলো কয়েক হাজার টন ওজনের একটি বাড়ি!
চট্টগ্রাম মহানগরীর পাথরঘাটার ১১৮ হাজী নজুমিয়া লেনে অবস্থিত এই পুরনো বাড়িটি দেখতে এখন প্রতিদিনই ভিড় করছেন হাজারো মানুষ। স্থপতিরাও অবাক এই নির্মাণশৈলী দেখে। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞরাও।
চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন হাজী শরীয়ত উল্লাহ। তৎকালীন বার্মার (মায়ানমার) রাজধানী রেঙ্গুনের সঙ্গে ব্যবসা ছিল তার। নিজের দুটি জাহাজযোগে মালামাল নিয়ে যেতেন রেঙ্গুনে, একইভাবে ফিরেও আসতেন। প্রায় ৩০০ বছর আগে ১২ শতক জায়গার উপর এই বাড়িটি তিনিই তৈরি করেছিলেন।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর চতুর্থ প্রজন্ম মোহাম্মদ ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমার ফুফু অনেক আগে আমাদের বলেছিলেন এই বাড়িটি মটকার উপর তৈরী করা হয়েছে। এই মটকা ও বাড়ি তৈরীর শ্রমিকও আনা হয়েছিলো রেঙ্গুন থেকে। ভবনটি নির্মাণ করতে সে সময়ের ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। এখন বাড়ি ভাঙতে গিয়ে তার কথার মিল পাচ্ছি।"
তিনি জানান, তাদের প্রপিতামহ হাজী শরীয়ত উল্লাহ সওদাগরের এই বাড়িটি সময়ের পরিক্রমায় দুই পরিবারের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ পড়ে হাজী বাদশা মিয়া সওদাগরের বংশধরদের ভাগে। অন্য অংশের মালিক তার ভাই হাজী আবুল বশর সওদাগরের সন্তানেরা। এখন হাজী বাদশা মিয়া সওদাগরের সন্তানেরা তাদের অংশ ভেঙে নতুন করে সাততলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। গত ৩ জুন পুরোনো বাড়ির ছাদ ও দেয়াল অপসারণের পর মেঝে খনন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে মাটির মটকা। এটা জানাজানি হতেই 'গুপ্তধন' পাওয়া গেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
এখন পর্যন্ত শ্রমিকরা ওই ভবনের নিচ থেকে ৩৪টি মটকা উদ্ধার করেছে। অধিকাংশ পাত্রের উচ্চতা গড়ে দুই ফুট। মুখের ব্যস ৫৬ ইঞ্চি। একেকটি পাত্রের ওজন ১০ থেকে ১৫ কেজি। ধারণা করা হচ্ছে বাড়ির ভিতের নিচে এখনো অন্তত ২৫০টি মটকা রয়েছে।
এদিকে পুরোনো ভবনের নিচ থেকে মটকা বেরিয়ে আসার খবরে ছুটে আসেন বিশেষজ্ঞরা। রোববার (১১ জুলাই) বাড়িটি পরিদর্শনে আসেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম. সাইফুর রহমান।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পুরো বাড়ি ও মটকাগুলো দেখে মনে হয়েছে এটা প্রায় তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ বছর আগের স্থাপত্যশৈলী। এর আগে মুন্সিগঞ্জের ইন্দ্রাকপুরে একটি দুর্গে এভাবে কলস ব্যবহার করা হয়েছে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি মীর জুমলা খাঁ দুর্গ তৈরিতে এভাবে মটকা ব্যবহার করেছিলেন। প্রাথমিক দেখায় মনে হয়েছে ভূমিকম্প নিরোধ ও বাড়িকে ঠান্ডা রাখতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। আরও পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর বিস্তারিত বলা যাবে।"
চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলিউর রহমান বলেন, "মটকাগুলো দেয়ালের নিচে কিছুদূর অন্তর অন্তর সারিবদ্ধভাবে রাখা ছিল। চারপাশে মাটি এবং উপরেও মাটি দিয়ে ভরানো। এর ওপরেই বাইশ ইঞ্চি পুরু দেয়ালের গাঁথুনি। পুরনো দিনের এ ভবনটি অন্তত বিশ ফুট উচ্চতার, যা এখনকার দ্বিতল ভবনের সমান। হাজার টন ওজনের এই দেয়ালের ভার মটকাগুলো কীভাবে বহন করত তা ভাবতেই বিস্ময়কর।"
"আজ রোববার ওই ভবনের ভেতর থেকে একটি পুরোনো আমলের খাট, একটি সিন্দুক, দেয়াল ঘড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। ঘরের মাঝখানে কুয়া। সেই কুয়াতে এখনও বিশুদ্ধ পানির ধারা প্রবাহমান," বলেন আলিউর রহমান।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "আজ থেকে তিন-চারশ বছর আগে ভবন নির্মাণে রড-সিমেন্টের ব্যবহার ছিল না। চুন, সুরকি এবং বিভিন্ন ধরনের মাটি দিয়ে ভবনের ভিত্তি ও কাঠামো নির্মিত হতো। এই ভবনেও সুরকি ও চুনের সঙ্গে মাটির মটকার ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে ভবনে মটকার ব্যবহার খুব বেশি নেই। সম্ভবত কর্ণফুলী নদী ও সাগর তীরবর্তী হওয়ায় জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে এ প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে"।
চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর বলেন, "প্রত্নতত্ত্ব আইন অনুযায়ী ওই বাড়ি প্রত্ন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। ইতোমধ্যেই না জেনে বাড়িটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এখন যেটুকু অক্ষত রয়েছে, তা সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে।"