ইসরায়েলে ৭ হাজার বছর প্রাচীন গ্রামে মিলেছে ভারতবর্ষের তুলায় তৈরি কাপড়ের নমুনা
আজ যেখানে আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত সেই ভূমিতে ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক গ্রাম– তেল তাসাফ। খনন কাজ চালিয়ে এই গ্রামটি আবিষ্কার করেছেন ইসরায়েলের প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সম্প্রতি তারা এখানে করেছেন চমকপ্রদ এক আবিষ্কার, জানিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার বছর আগে এই গ্রামে কেউ তুলার সুতায় তৈরি কাপড় এনেছিলেন বিশ্বের সুদূর প্রান্ত থেকে। খবর হারেৎজের
জেনে রাখা ভালো– নিকটপ্রাচ্যে উদয় হওয়া প্রথমদিকের সভ্যতাগুলোয় তুলার প্রচলন ছিল না। কারণটাও খুব সহজ, এই উদ্ভিদটি এই অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ ছিল না সেসময়ে। কবে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা তুলা চাষ শুরু করেছিলেন তাও মোড়া রহস্যের চাদরে। ফলে তেল তাসাফে এত প্রাচীনকালের তুলার নমুনা পেয়ে বিস্মিতই হন পুরাতত্ত্ববিদদের দলটি।
এই গবেষকরা জানান, নিকটপ্রাচ্যে পাওয়া তুলার নমুনার মধ্যে এটি সবচেয়ে প্রাচীন। তাদের ধারণা, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা থেকে এটি আনা হয় তেল তাসাফে। তবে আফ্রিকা থেকেও আসার সম্ভাবনা তারা উড়িয়ে দেননি।
সিন্ধু সভ্যতা হোক (বর্তমানে যেখানে আধুনিক পাকিস্তান) বা উত্তর আফ্রিকা– সেখান থেকে বাণিজ্যের মাধ্যমেই তুলা আসে বলে জানান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিসেসজ্ঞ লি লিউ এবং আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ মরিস লেভিস। একই ধারণা পোষণ করেন, জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি স্টেট মিউজিয়ামের ফ্লোরিয়ান ক্লিমশচা এবং ইসরায়েলের হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানি রোসেনবার্গ। তারা এই ব্যাখ্যাটি লিখেছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল– ফ্রন্টিয়ার্স ইন প্ল্যান্ট সায়েন্স- এ প্রকাশিত নিবন্ধে।
শেষ নিওলিথিক যুগের সুসময়
তাল তাসাফে সন্ধান মেলা গ্রামটি ৭,২০-৭,৩০০ বছর আগে গড়ে ওঠে। এটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল ৫০০ বছর ধরে, তারপর কোনো কারণে এটি পরিত্যাক্ত হয়, যা আজো জানতে পারেননি প্রত্ন-গবেষকরা। চারপাশে কেন্দ্রীয় জর্ডান উপত্যকা, দক্ষিণে গ্যালিলি উপসাগরের মতো সমৃদ্ধ পরিবেশ থাকার পরও, গ্রামটি জনশূন্য হয়ে যাওয়ার ঘটনাটাও খুবই রহস্যাবৃত বলে উল্লেখ করেন রোজেনবার্গ। তবে এখানে যখন মানুষ বসবাস করতো, তখন এটি সে যুগের হিসাবে বেশ সমৃদ্ধ এক জনপদ ছিল বলেও জানান তিনি।
যেমন এখানেই মিলেছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন তামার তৈরি বস্তু। একটি মাটির তৈরি শস্যাগার বা সাইলোর নমুনা। এতে খাদ্যশস্য চাষাবাদ ও তার সংরক্ষণ সম্পর্কে স্থানীয়দের দক্ষতা ও জ্ঞান প্রমাণিত হয়। আরও মিলেছে ৭ হাজার বছর আগের সিলমোহর। এসব মিলিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, শেষ নিওলিথিক যুগের এক বিস্ময়কর সম্পদশালী জনপদ ছিল তেল তাসাফ।
আর এই সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস ছিল বাণিজ্য। একারণেই এখানে তুলার মাইক্রোফাইবার বা সূক্ষ্ম কণার নমুনা খুঁজে পেয়েছেন রোজেনবার্গ ও তাদের সহকর্মীরা। কয়েকটি তন্তু আবার নীল ও অন্যান্য রঙের ছিল, ফলে এগুলো কোনো সুতি কাপড়ের অংশ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে পূর্ব জর্ডানের ধুয়েলিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে প্রাচীন তুলার নমুনা মেলে। গবেষকরা অনুমান করেন এটি ৬,৪৫০ বা ৫,০০০ বছর আগের।
রোজেনবার্গ বলেন, তুলার ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় পোশাকে-আশাকে বিপ্লব আনে। এমন নয় আগে মানুষ শীত থেকে রক্ষার কোনো উপায় জানত না। তবে তাদের পরিধেয় ছিল পশু চামড়ার। কাপড় বুননে তুলাসহ নানান রকম উদ্ভিজ্জ তন্তুর ব্যবহার ধীরে ধীরে বড় পরিবর্তন আনে। শরীর ঢাকা, তীব্র গরম বা শীত থেকে রক্ষা এবং সামাজিক আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠতে থাকে পোশাক।
ধারণা করা হয়, আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে উদ্ভিজ্জ তন্তুর ব্যবহার শেখে মানুষ। যেমন ২০২০ সালে ফ্রান্সে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক নিয়ানডার্থাল মানুষের বসতিতে তিন পরতে পাকানো রশির নমুনা পান। এর আগে ইসরায়েলেই ২৩ হাজার বছর আগে পাকানো রশির সন্ধান মেলে। তবে ফ্রান্সের নমুনাটিই সবচেয়ে প্রাচীন।
প্রাগৈতিহাসিক মানব গোষ্ঠীগুলো এই পাকানো রশি কী কাজে ব্যবহার করতো তা জানা যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানান, রশি পাকানোর দক্ষতা তাদের বস্ত্রবয়নের দিকে অগ্রগতি হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের ইঙ্গিত।
তবে উদ্ভিজ্জ তন্তুতে বোনা কাপড়– প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন হিসেবে দীর্ঘকাল পর খুব একটা পাওয়া যায় না। কারণ কাপড় জীর্ণ হয়ে মাটিতেও মিশে যায় কালের আবর্তে।
অধুনা পাকিস্তানের তুলা চাষের প্রাচীন ইতিহাস
রাষ্ট্র গড়ে, রাষ্ট্র ভাঙ্গে– কালের পরিক্রমায়; কিন্তু ভূখন্ডের ইতিহাস তো আরও প্রাচীন। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই।
কিন্তু, কেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেছেন, তেল তাসাফে পাওয়া তুলার নমুনা নিকটপ্রাচ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নয়, বা উত্তর আফ্রিকা থেকে আসার সম্ভাবনা কম?
এর পেছনে প্রধান কারণ, ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে যেখানে পানি সেচের সুব্যবস্থা আছে সেখানে সবচেয়ে ভালো জন্মায় তুলা গাছ। রোজেনবার্গ জানান, সিন্ধু সভ্যতার চেয়ে উত্তর আফ্রিকায় অনেক পরে চাষাবাদের কাজ শুরু হয়। ফলে প্রাথমিক কৃষিতে সিন্ধু অঞ্চলই এগিয়ে ছিল। আর তুলা ছিল এখানকার স্থানীয় উদ্ভিদ, যা আবহাওয়ার কারণেও প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো।
পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের মেহেরগড় সমাধিক্ষেত্রে তুলা ব্যবহারের সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা পাওয়া গেছে। মৃতের সাথে তুলার সুতায় বুনিত তামার পুঁতির মালা দিত সিন্ধু সভ্যতার মানুষ। এই নমুনাটি সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৭ হাজার বছর প্রাচীন।
রোজেনবার্গ মনে করেন, চাষের অনেক আগেই সিন্ধু সভ্যতার মানুষ প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বুনো তুলোর ব্যবহার করেছে। মেহেরগড় বা তেল তাসাফের নমুনাও সেভাবেই এসেছে। এর আরও প্রায় দুই হাজার বছরের বেশি সময় পর তুলা চাষ শুরু হয়। হরপ্পা সভ্যতার সময়ে (খৃষ্টপূর্ব ২৬০০-১৯০০) এর চাষ শুরু হয় বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।