মাঠ আধুনিক হলেও খেলার সুযোগ নেই স্থানীয় শিশু-কিশোরদের!
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) 'জলসবুজে ঢাকা প্রকল্পের' আওতায় আট কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে পুরান ঢাকার ঢাকেশ্বরীর শহীদ আব্দুল আলিম খেলার মাঠ আধুনিকায়ন করা হলেও সেখানে খেলার সুযোগ নেই সাধারণের। অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে মূল খেলার মাঠটি। এছাড়া নেটে প্র্যাকটিসের স্থানে স্থানীয় শিশু কিশোরদের সুযোগ না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মাঠটির উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয় যা শেষ হলে ২০১৯ সালে ১৬ নভেম্বর উদ্বোধনের মাধ্যমে সর্বসাধারণের জন্য মাঠটি উন্মুক্ত করা হয়। মাঠটির কাজ শুরুর আগে মাঠের চারপাশে ঝুপড়ি ঘর, দোকান ও ময়লার স্তূপ থাকলেও ছোট পরিসরে খেলার সুযোগ ছিল শিশু কিশোরদের। এখন আধুনিকায়ন হওয়ার পরে পরিবেশ সুন্দর হলেও খেলার সুযোগ নেই সাধারণ শিশু কিশোরদের। মাঠ সংলগ্ন একটি ক্রিকেট একাডেমি এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক কিশোর ও স্থানীয় যুবকরা এটা ব্যবহার করে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এছাড়া মাঠের পাশে দুপুর ও সন্ধ্যায় বখাটেদের নেশার আড্ডা বসে বলেও অভিযোগ তাদের।
ডিএসসিসি 'জলসবুজে ঢাকা প্রকল্প'র আওতায় ৭৫ কাঠা জমির উপরে আধুনিকায়ন করা এ মাঠটি 'বিশ্বমানের' হিসেবে দাবি করা হলেও স্থানীয় শিশু কিশোররাই এর সেবা থেকে বঞ্চিত। এ প্রকল্পের আওতায় আরও ৩০টি খেলার মাঠ ও পার্কের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান ডিএসসিসি কতৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, মূল মাঠের চারদিক সুউচ্চ লোহার নেট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। মাঠে প্রবেশের দ্বারে তালা থাকায় মাঠের ভিতরের ঘাসগুলো হাঁটুর সমান লম্বা হয়ে আছে। নেই রক্ষণাবেক্ষণের তোড়জোর। কফি শপ, রেস্টুরেন্ট থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মাঠটির রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বাইরে ওয়াকওয়ের পাশে বসার স্থান রয়েছে কয়েকটি। সকালে ও সন্ধ্যায় স্থানীয়রা মাঠটির পাশের ওয়াকওয়েতে হাঁটতে পারলেও খেলার সুযোগ নেই মাঠে। মাঠের উত্তর-পূর্ব কোণে দুই তলা একটি ভবন। এর নিচতলায় জিমনেশিয়াম ও লাইব্রেরি এবং ওপরের তলায় কফি হাউস ও একটি উন্মুক্ত ফুলের বাগান।
কিন্তু জিমনেশিয়ামের কক্ষে তালা এবং এর যন্ত্রগুলো তেমন ব্যবহার হয় না বলেই লক্ষ করা যায়। পূর্বপাশের মসজিদ সংলগ্ন ছোট পরিসরে একটি শিশু কর্নার পড়ে আছে অযতনে।
মাঠে ফুটবল এবং নেটে ক্রিকেট খেলার প্র্যাকটিস স্পেস ছাড়াও এর পাশে রয়েছে হাঁটার জন্য ২৫০ মিটার ওয়াকওয়ে, আধুনিক টয়লেট, ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি, ওয়াটার ফিল্টার, সিসি ক্যামেরা, ডাস্টবিন, ফলের গাছ। সেগুলোর রক্ষনাবেক্ষণও হয়না নিয়মিত। এছাড়া ঈদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে মাঠটিতে।
পার্কের ওয়াকওয়ের নিচে তৈরি করা হয়েছে জলাধার। এতে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন পানি ধরে রাখা যাবে। ফিল্টারিং করে সেই পানি পান করা যাবে। আর রাতে খেলার জন্যও রয়েছে আলোর ব্যবস্থা। কিন্তু এগুলো ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
তবে এতো সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মাঠটি পড়ে থাকে অব্যবহৃত অবস্থায়। শুধু তাই নয় স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছের লোকজনই শুধু মাঠে খেলার সুযোগ পায় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন কিশোর।
মাঠের পাশের নেটে প্র্যাকটিস করতে আসা আপন সাহা টিবিএসকে বলেন, 'মাঠ সবসময় খোলা থাকে না। আর খুললেও নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যতীত খেলার সুযোগ পায় না।মাঝে মাঝে নেটেও আমাদের প্র্যাকটিস করতে দেয় না। মাঠটি মূলত শিশুদের জন্য করা হলেও শিশুদের খেলার সুযোগ নেই'।
মাঠে একটি ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য মাঠটির রক্ষনাবেক্ষণকারী তার কাছে ২৫ হাজার টাকা দাবি করেছিল উল্লেখ করে আলী আনাস হৃদয় নামে এক যুবক বলেন, 'এ মাঠে তো কাউন্সিলরের লোকজন ব্যাতীত অন্য কারো খেলার সুযোগ নেই। আমরা রাতে একটা ম্যাচ খেলতে চেয়েছিলাম পরে আমার কাছে ২ ঘন্টা খেলার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং দিনে খেলতে ২০ হাজার টাকা দাবি করে'।
মাঠের পাশে বসার স্থানে বিশ্রাম নেওয়া রমিজ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের অনেক দিনের দাবি ছিল এ স্থানটি যাতে দখলমুক্ত করা হয় কিন্তু এখন আধুনিক হলেও বাচ্চাদের খেলার সুযোগ নেই। এর থেকে তখন স্বল্প পরিসরে হলেও তো বাচ্চাদের খেলার সুযোগ ছিল'।
এদিকে মাঠটি তৈরীর প্রকল্পটি রাশিয়াভিত্তিক 'ইউরেশিয়ান প্রাইজ ২০২০' এ ভূষিত হয়েছে। 'নগর পরিকল্পনা' ক্যাটাগরিতে অন্যতম সেরা প্রকল্প হিসাবে 'শহীদ আব্দুল আলিম খেলার মাঠ' এ পুরস্কার জিতে নেয়। প্রকল্পটির প্রধান স্থপতি রফিক আজম।
প্রতিযোগিতাটির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আগামী অক্টোবর মাসের ২ তারিখে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
প্রকল্পটির প্রধান স্থপতি রফিক আজম টিবিএসকে বলেন, 'আমি চেষ্টা করেছি একটি ময়লার ভাগাড়কে এ এলাকার মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য। সেটা আমি পেরেছিও। এর জন্য আমাকে সবাই সাহায্য করেছেন কিন্তু বেশ কিছু বাঁধারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য এমন একটা স্থান করতে চেয়েছি যেখানে খেলাধুলার জন্য কোনো দেয়াল থাকবে না। তাই এ মাঠটি সবুজায়িত করে সবার ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে'।
'সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন জায়গায় শত শত কোটি টাকার কাজ হয় কিন্তু এ মাঠটিকে সৌন্দর্যময় করতে খরচ হয়েছে মাত্র আট কোটি টাকা। এভাবে ছোট ছোট উদ্যোগের মাধ্যমেই ঢাকাকে আমাদের বাসযোগ্য করে তুলতে হবে'।
মাঠটি ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার না হওয়ার বিষয়ে এ স্থপতি বলেন, 'আমার দায়িত্ব মাঠটি পর্যবেক্ষণের না। এ দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আমার দায়িত্ব যা ছিল তার বাহিরেও নিজ থেকে কিছু কাজ করেছি। এখন এটার সঠিকভাবে ব্যবহার ও রক্ষনাবেক্ষণ না হলে এটা সবার জন্য লজ্জাকর'।
ডিএসসিসি'র ২৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক টিবিএসকে বলেন, 'করোনার জন্য গত এক মাস ধরে মাঠটি বন্ধ আছে। এর আগে মাঠে সবাই নিয়মিত খেলাধুলা করেছে তবে মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সকালে এবং বিকালে নির্দিষ্ট সময়ে মাঠটি খোলা হতো। যদি মাঠটি নিয়মিত এবং সঠিকভাবে ব্যবহার না হতো সেক্ষেত্রে তো আর আন্তর্জাতিক পুরষ্কার জেতা সম্ভব না'।
করোনার মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তো খেলাধুলার প্রয়োজন সেখানে মাঠ বন্ধ রাখা কতোটু্কু যুক্তিযুক্ত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'মাঠের চারদিক হাঁটার জায়গা খুলে দেওয়া রয়েছে, এখানে প্রতিদিন মানুষ সকাল-বিকালে হাঁটে। এছাড়া পাশে ছোট জায়গা রয়েছে সেখানেও শিশু কিশোররা খেলাধুলা করতে পারে নিয়মিত। এখানে কাউকে বাঁধা দেওয়া হয় না'।