যাত্রী খরায় লোকসান গুনছে গণপরিবহনগুলো
লকডাউন উঠার পর থেকে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ৫০ ভাগ গণপরিবহন চলার কথা, তবে যাত্রীর অভাবে সেই ৫০ ভাগ পরিবহন চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে গণপরিবহন মালিকরা। দীর্ঘ বন্ধের কারণে ক্ষতি পোষানোটাও এখন কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের জন্য।
বিভিন্ন টুরিস্ট স্পট বন্ধ থাকা, মানুষের আয় কমে যাওয়া ও কোভিডের ভয়ই যাত্রী কমার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
"দেশের সকল টুরিস্ট স্পট বন্ধ, এছাড়া মানুষের মধ্যে কোভিডে আক্রান্তের ভয় কাজ করছে। ফলে তারা এখন আর বাইরে বের হতে বা কোথাও যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। আবার মানুষের আয় কমে গেছে, হাতে টাকা কম, তাই তারা খুব প্রয়োজন ব্যতীত কোথাও যাচ্ছে না", বলেন গ্রিন লাইন পরিবহনের ম্যানেজার সফিউল্ল্যাহ।
"আগে যেখানে আমাদের প্রতিদিন ৬০-৭০টি ট্রিপ ছিল, এখন তা ২০টির নিচে নেমে গেছে। আমাদের আয় এমন অবস্থায় চলে গেছে যে আমরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছি না। অথচ এই দেড় বছরে সুদের পরিমাণ বেড়েই চলছে", যোগ করেন অভিজাত বাস সার্ভিস কোম্পানির এই কর্মকর্তা।
একই কথা বলেন সোহাগ পরিবহনের সেলস ম্যানেজার আমিরুল ইসলামও। তিনি বলেন, "আমরা এখন ৪০%-৪৫% ট্রিপ চালাচ্ছি। কিন্তু সেই গাড়িরও সিট ফাঁকা থাকছে"।
"একটি ট্রিপে যে পরিমাণ খরচ হয় সেই টাকা উঠানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে", তিনি যোগ করেন।
রয়েল পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার (মাজার রোড) মোহাম্মদ আহসান হাবীব বলেন, "উত্তরাঞ্চলের তিনটি রুটে আমাদের গাড়ি চলে। আগে প্রতিদিন ১৮ ট্রিপ চালাতাম। এখন ৯টি চালানোই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। যাত্রী পাচ্ছিনা। মাঝে মাঝে যাত্রীর অভাবে ট্রিপও বন্ধ রাখতে হচ্ছে"।
নাবিল পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, "আমরা উভয় সংকটে আছি। প্রথমত, যাত্রী খুবই কম। তার উপর রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। শুধুমাত্র চন্দ্রা থেকে গাবতলী পর্যন্ত আসতে বর্তমানে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগছে। সাধারণত এই পথ ১-২ ঘণ্টার মধ্যেই পার হওয়ার কথা"।
"এই জ্যামের জন্যও আমাদের ট্রিপ কমে যাচ্ছে", যোগ করেন তিনি।
এদিকে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোও ভুগছে যাত্রী খরায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ প্যাসেঞ্জার ক্যারিয়ার এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল বলেন, "লঞ্চে যাত্রী কম থাকায় আমাদের প্রতি ট্রিপেই ক্ষতি হচ্ছে। আমরা ক্ষতি পোষাতে ভাড়া বাড়াতে চেয়েছিলাম কিন্তু সরকার তাও করতে দেয়নি। তাই এখন ট্রিপের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে"।
তিনি বলেন, "বহু মালিক ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ব্যাংকের দেনা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে তা ফেরত দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে"।
তবে সিটি বাসের ক্ষেত্রে অবস্থা কিছুটা ভাল। তারা মোটামুটি যাত্রী পাচ্ছেন। ট্রিপও মারছেন প্রায় আগের মতই।
"মোটামুটি যাত্রী পাচ্ছি। তবে আগের মত ভিড় হচ্ছে না। আগে প্রতিদিন দুটো ট্রিপ চালাতাম। এখনও দুটোই চালাচ্ছি", বলেন সাভার-সাইনবোর্ড লাইনের লাব্বাইক বাসের হেলপার মোঃ রুবেল।
গাবতলী-সদরঘাটের আট নাম্বার বাসের ড্রাইভার মোঃ কাইয়ূম বলেন, "আমরা আগে প্রতিদিন ৬-৮টা করে ট্রিপ চালিয়েছি, এখনও সেই পরিমাণই চালাচ্ছি। শহরে বাসের পরিমাণ কম থাকায় যাত্রীরও চাপ কিছুটা আছে। কিন্তু সেটা আগের তুলনায় অনেক কম"।
এই অবস্থায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিক উভয়েই এখন সরকারের সাহায্যের দাবি জানাচ্ছেন।
"আমরা কিভাবে আগের ক্ষতি পোষাব সেটা বুঝতে পারছি না। এই মুহুর্তে কোন পথই খোলা নাই। সরকারও এই সেক্টরে কোন ধরনের সহযোগিতা করছে না", বলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
"অনেক মালিকই এখন সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে, বিশেষ করে যারা একটি-দুটি বাসের মালিক ও দুই তিনজন মিলে একটি বাস চালাচ্ছেন। যাদের ঋণ আছে তারা সেটা পরিশোধ করতে পারছে না। আমরা সরকারের কাছে দাবি করেছিলাম আমাদের ব্যাংক ঋণের সুদ ও রোড ট্যাক্স মওকুফ করার জন্য, কিন্তু সেটাও করেনি", তিনি যোগ করেন।
"এরকম অবস্থা যদি চলতে থাকে তবে অনেকেরই এই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। এই মুহূর্তে এই সেক্টরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে সরকারের সহযোগিতা দরকার", বলেন এনায়েত উল্যাহ।
এদিকে আয়ের অভাবে পরিবহন শ্রমিকরাও কষ্টে আছে। জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের বিজ্ঞাপন সচিব মো. জামিরুল হক লিটন বলেন, "যাত্রী কমার কারণে আয় কম হচ্ছে। তার উপর অর্ধেক গাড়ি চলার কারণে অনেক শ্রমিক বসে আছে। আয় না থাকার কারণে মালিকরাও কোন সহযোগিতা করতে পারছে না। আমরা খুবই কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। সরকারের সহযোগিতা আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে"।