যেভাবে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশের কারাগারগুলো
অবৈধ মাদকসহ আটক হওয়ায় দায়ে অভিযুক্ত শায়াজ (ছদ্মনাম) এক বছরের বেশি সময় ধরে কেরাণীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজা খাটেন। তবে, এই দীর্ঘ সময়েও তিনি কারাগারে কোনো কোভিড আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার সংবাদ পাননি।
কেউ যাতে আতঙ্কিত না হয়, সেজন্য কারাগার কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোভিড সংক্রমণের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সম্ভবত সে কারণেই শায়াজ কারও কোভিড শনাক্ত হওয়া সম্পর্কে অবগত নন।
কেরাণীগঞ্জ কারাগারে কোভিড আক্রান্ত শনাক্ত হলেও সংখ্যাটি খুবই সামান্য।
কেরাণীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, "২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে মাত্র ১৯ জন বন্দী এবং ৩৯ জন কারারক্ষীর করোনা শনাক্ত হয়।"
প্রশ্ন হল- আবদ্ধ কারা প্রকোষ্ঠে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক বন্দী থাকা সত্ত্বেও সংক্রমণের হার কীভাবে এত কম?
কেন্দ্রীয় এবং জেলা কারাগারসহ বাংলাদেশে ৬৮টি কারাগার আছে। দেশের কারাগারে ৪২ হাজার ৪৫০ জনের ধারণক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে কারাবন্দীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।
বর্তমানে, কেরাণীগঞ্জ কারাগারের একেকটি প্রকোষ্ঠে দুই থেকে তিন জন এবং ওয়ার্ডগুলোতে ২০-২৫ জন কারাবন্দী থাকছে বলে জানান জেল সুপার সুভাষ। মহামারি-পূর্ব সময়ে ওয়ার্ডে বন্দীর সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ পর্যন্ত ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে, দেশের সকল কারাগারে কর্তৃপক্ষ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে নতুন প্রটোকল জারি করে।
গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে আছে মাস্ক পরিধানসহ নতুন আগত বন্দীদের জন্য ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন পালন এবং আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড স্থাপন। এছাড়া, কারাবন্দীদের সাথে পরিবারের সশরীরে সাক্ষাৎ ব্যবস্থা বন্ধ করে সাপ্তাহিক ফোনালাপের ব্যবস্থা করা হয়। এর বাইরে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করাসহ বিভিন্ন নীতিমালা গৃহীত হয় ।
সুভাষ আরও জানান, কোনো কারারক্ষী বা কর্মচারীর করোনা শনাক্ত হলে তাদের অবিলম্বে দায়িত্ব পালনে অব্যাহতি দিয়ে ঘরে পাঠানো হয়। পুনঃপরীক্ষায় করোনার ফলাফল নেগেটিভ আসলে তারা পুনরায় কাজে যোগদান করেন।
কারাবন্দীদের ক্ষেত্রে তাদের আইসোলেশন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসের (আইসিআরসি) উদ্যোগে কেরাণীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ৭০ শয্যার আইসোলেশন কেন্দ্র স্থাপিত হয়।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার ২০২০ সালের মে মাসে করোনায় আক্রান্ত প্রথম কারাবন্দীর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করে। মৃত ব্যক্তির বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম কারাগারের ৩৭ বছর বয়সী একজন আসামি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, "ছয় মাস ধরে দায়িত্বপালনকালে আমি এখানে মাত্র একজন বন্দী এবং একজন কারারক্ষীকে করোনা আক্রান্ত হতে দেখেছি।"
অন্যদিকে, রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন পর্যন্ত কোনো কয়েদি বা হাজতি সংক্রমিত না হলেও একজন কারা কর্মী করোনা শনাক্ত হন।
ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে গত আট মাসে কোনো বন্দী বা কারা সদস্যের করোনা শনাক্ত হয়নি বলে জানিয়েছে কারাগারের একটি সূত্র।
সহকারী কারা পরিদর্শক জেনারেল মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, করোনার উপসর্গ দেখা দিলে বন্দীদের নিজ নিজ কারাগারের আইসোলেশন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করা হয়।
ফলাফল পজিটিভ আসলে অর্থাৎ, করোনা শনাক্ত হলে গুরুতর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।
তবে, সংস্পর্শে আসা অন্যদের, কিংবা উপসর্গ ছাড়া কেউ আক্রান্ত হয়ে থাকলেও তাদের করোনা পরীক্ষা করা হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডক্টর এ এম জাকির হুসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নতুন প্রকরণগুলো প্রাণঘাতী হলেও প্রকৃতপক্ষে করোনা ভাইরাস মৃদু জ্বর এবং ঠান্ডাজনিত একটি ভাইরাস। তবে, ৮০ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির, বিশেষত তরুণ এবং পরিশ্রমী মানুষের মাঝে মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গ দেখা যায় কিংবা, একেবারেই কোনো উপসর্গ দেখা যায় না।"
"সুতরাং, বিষয়টি অসম্ভব যে কারাবন্দীরা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়নি বা হচ্ছে না। বরং, তাদের উপসর্গ হয়তো লক্ষণীয়
না," বলেন তিনি।
তবে, কারাবন্দীদের মধ্যে সংক্রমণের নিম্নহারের বিষয়টির সাথে একমত নন প্রীতম (ছদ্মনাম)। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নয় মাস তিনি কেরাণীগঞ্জ কারাগারে ছিলেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে প্রীতম বলেন, "কারা কর্মচারীরা যদি একজনের সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে, তাহলে ৪০ জন সংক্রমিত হয়েছে বলে ধারণা করে নেওয়াটাই নিরাপদ। কেননা, ওয়ার্ডে কেউ সংক্রমিত হলে তা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে।"
মহামারির পূর্বে গাদাগাদি করে নয়মাস জেলে কাটানোর কথা স্মরণ করে প্রীতম বলেন, সেখানে চিকিৎসকের সাক্ষাতলাভের বিষয়টিও সময়সাপেক্ষ। প্রথমে ওয়ার্ড ইন চার্জকে অবহিত করতে হয়। তিনি মেডিকেল গেটে
বার্তা পাঠান। সেখান থেকে দায়িত্বপালনরত চিকিৎসককে খবর পাঠানো হয়।
কেরাণীগঞ্জে প্রীতম যেখানে সাজা খেটেছিলেন, সেখানে বর্তমানে নয় হাজারের বেশি কারাবন্দী আছে। কিন্তু, কারাগারটির ধারণক্ষমতা মাত্র চার হাজার ৫৯০ জনের। বন্দীদের জন্য মাত্র তিনজন ডাক্তার এবং তিনজন মেডিকেল সহকারীর ব্যবস্থা আছে বলে জানান জেল সুপার।
মহামারির শুরুতে আইসিআরসি বাংলাদেশের কারাগারগুলোর সাথে কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে।
আইসিআরসির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান রায়হান সুলতানা তমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "সংক্রামক ব্যধি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কারাবন্দীদের ঝুঁকি এবং অন্যান্য জটিলতায় মহামারির কারণে কারাগারগুলোর চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পায়।"
"করোনায় কারাবন্দী এবং কারারক্ষীদের মধ্যে সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাস করতে আইসিআরসি ৬৮টি কারাগারে মানদণ্ড অনুযায়ী কার্যক্রম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কারা কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করে," বলেন তিনি।
আইসিআরসি নির্ধারিত কারাগারগুলোতে তিনটি কোভিড-১৯ আইসোলেশন কেন্দ্র স্থাপনেও সাহায্য করে। এছাড়া, পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আবাসন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে তাঁবু স্থাপন এবং কারা কর্মচারীদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ, সংক্রমণ প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে সংস্থাটি। এর বাইরে তারা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী ও অন্যান্য চিকিৎসা ও চিকিৎসা বহির্ভূত বিভিন্ন সামগ্রী দিয়েও কারা কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করে।
আইসিআরসির কারা চিকিৎসক সরাসরি কারাবন্দীদের চিকিৎসা করেন না। তবে, তারা কারা কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।
মহামারির সময় বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকরা আইসিআরসিকে বিভিন্ন কারাগারে কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা করে।
বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে কোভিড শনাক্ত এবং মৃতের প্রাতিষ্ঠানিক সংখ্যাকে আক্ষরিক ভাবে নিলে বলা যায় যে, ভীড়পূর্ণ স্থানে কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দেশের কারাগারগুলোতে একটি সফল কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা মডেল আছে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কারাগারে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের অসংখ্য প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সামনে এসেছে। এর মধ্যে আছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, হাইতি, মেক্সিকো, ভারত, পাকিস্তান, ইতালি, কানাডা এবং ইরানের নাম। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাবন্দীরা কোভিড সংক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত হন। সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে আছে থাইল্যান্ডের নাম।
শুধু সংক্রমণই নয়, একই সময়ে কারাগারে সংগঠিত দাঙ্গার কারণেও কারাবন্দীদের মৃত্যুর সংবাদ সামনে এসেছে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলার প্রতিবাদে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় এসব আন্দোলন সংগঠিত হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে, এখন পর্যন্ত প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বাংলাদেশের কারগারগুলোর কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনাকে বেশ সফল বলেই মনে হবে।