যে শহরে মাটির নিচ ও উপরে টানা হয় বিদ্যুতের লাইন!
সিলেটে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় প্রায় ১২০০ মেঘাওয়াট। আর এখানে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৩১০ মেগাওয়াট। তবু সিলেটে লেগে থাকে বিদ্যুৎবিভ্রাট।
বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, সিলেট ঝড়বৃষ্টি প্রবণ এলাকা। ফলে চাহিদামাফিক সরবরাহ পেলেও ঝড়ে ছিঁড়ে যায় বিদ্যুতের লাইন। তাই দেখা দেয় বিদ্যুৎ বিভ্রাট।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ২০১৭ সালে 'বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প, সিলেট বিভাগ' নামে এক হাজার ৮৯১ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের অধীনে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের কাজ করা হয়। নগরীর সাত কিলোমিটার এলাকায় মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের লাইন টানার কাজ শেষ হয়েছে। তবে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের লাইন টানার পর এখন আবার মাটির উপর দিয়ে লাইন টানছে বিদ্যুৎ ভিভাগ। ফলে এই প্রকল্পের সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যদিও প্রকল্পের শুরুতে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তারবিহীন হয়ে উঠবে নগরী। তবে ঝড়বৃষ্টিতে বিদ্যুৎবিভ্রাট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশপাশি সড়কের ওপর ঝুলে থাকবে না বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিসেবার তারের জঞ্জাল। ফলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে নগরীর।
সিলেটের শাহজালাল (র.) দরগাহ এলাকার এক কিলোমিটার সড়কে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে তারবিহীন সেই সড়কের ছবি দেশে-বিদেশে বেশ প্রশংসিতও হয়।
এরপর নগরীর ব্যস্ততম চৌহাট্টা-বন্দরবাজার সড়কে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন টানার কাজ শেষ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে মাটির লাইন দিয়ে লাইন টানার পর সম্প্রতি এই সড়কে মাটির উপরেও খুঁটি বসানো ও তার টানার কাজ শুরু হয়েছে। 'তারবিহীন নগরী' গড়ার কথা বলে ফের টানা হচ্ছে তারের জঞ্জাল।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু দেশে প্রথম এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তাই ভূ-গর্ভস্থ বিদ্যুৎ লাইনে কোনো কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। এজন্য ঝুঁকি এড়াতে মাটির নিচ দিয়ে তার টানার পাশাপাশি খুঁটি বসিয়ে উপর দিয়েও তার টানা হচ্ছে। মাটির নিচের লাইনে কোনো কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে উপরের লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন অব্যাহত রাখা হবে।
সিলেটের নাগরিক সংগঠন 'সংক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলন-এর সমন্বয়ক আব্দুল করিক কিম এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারবিহীন নগরী গড়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নগরীর প্রায় সব রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়। একবছর নগরীর সবাইকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুফলের কথা ভেবে আমরা তা মেনে নিই। কিন্তু এখন যদি আবার সড়কের উপরে তারের জঞ্জাল ঝুলে থাকে, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কী লাভ হলো? সরকারি টাকারও অপচয় করা হলো কেন?
সিলেট সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নগরীর সড়কজুড়ে বৈদ্যুতিক তারের প্যাঁচগোছ; বিদ্যুতের সঙ্গে টেলিফোন, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেটের তার মিলিয়ে রীতিমতো জঞ্জাল পাকিয়ে ছিল নগরীর সড়কগুলোর উপরে। এতে নগরীর সৌন্দর্যহানির পাশাপাশি সামান্য ঝড়বৃষ্টিতে তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে নগরী। এ দুর্ভোগ লাঘবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে নগরীতে শুরু হয় ভূ-গর্ভস্থ বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের কাজ। এতে সহায়তা করছে সিলেট সিটি করপোরেশন। বিদ্যুতের সঙ্গে অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের ক্যাবলও মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা।
শাহজালাল মাজার সড়কের পর এ প্রকল্পের আওতায় নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন কেন্দ্র থেকে আম্বরখানা হয়ে চৌহাট্টা-জিন্দাবাজার-বন্দরবাজার-সার্কিট হাউজ সড়ক ও রিকাবীবাজার হয়ে ওসমানী হাসপাতাল পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ লাইন টানা হয়। কিন্তু মাটির নিচ দিয়ে তার টেনে নেওয়ার পর এবার সড়কের মাঝখানে খুঁটি বসিয়ে আবার উপর দিয়ে তার টানা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল হক বলেন, সারা দেশের মধ্যে সিলেটে প্রথম ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের কাজ চলছে। এজন্য যেকোনো সময় কারিগরি ত্রুটি দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। মাটির নিচের লাইনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধান করতে অনেকটা সময় লাগবে। কিন্তু চৌহাট্টা-বন্দরবাজার সড়ক সিলেটের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা। নগরীর প্রাণকেন্দ্র ধরা হয় এ এলাকাকে। এলাকাটিতে দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকলে সমস্যা হবে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আমরা আপাতত মাটির উপর দিয়েও বিদ্যুতের লাইন টানছি।
আগে নগরীর সড়কের পাশে ছিল বিদ্যুতের খুঁটি ও লাইন। এবার ঠিক সড়কের মাঝখানে বিদ্যুতের খুঁটি বসিয়ে লাইন টানা হচ্ছে। এতে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের নামে আরও সৌন্দর্যহানির শঙ্কা প্রকাশ করছেন নগরবাসী।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) রুহুল আলম বলেন, এই তার সাময়িক সময়ের জন্য টানা হচ্ছে। ছয়-সাত মাস পর যদি দেখা যায় ভূগর্ভস্থ বিদ্যুলাইন ভালোভাবে কাজ করছে, তখন মাটির উপরের খুঁটি ও তার সরিয়ে নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, খুঁটি মাঝখানে বসানো হয়েছে কারণ ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) নির্মাণ করে এ খুঁটির পাশে গাছ লাগানো হবে। ফলে সৌন্দর্যহানি হবে না। এছাড়া এসব খুঁটিতে সড়কবাতিও লাগানো হবে।
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বিদ্যুতের খুটি বসিয়ে লাইন টানা হলেও ইন্টারেনট, স্যাটেলাইটসহ অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের তার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে আগের মতো জঞ্জাল দেখা দেবে না। সৌন্দর্যহানিরও শঙ্কা নেই।