রাজধানীতে অপরাধ সংঘটনের শীর্ষে গুলশান
জনসংখ্যায় ঢাকার অন্যান্য অংশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ না হলেও অপরাধের দিক থেকে শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনস্ত অপরাধ অঞ্চল গুলশান বিভাগ। খুন এবং ধর্ষণের উচ্চ হারে আশেপাশের জনবহুল এলাকাকেও ছাড়িয়ে গেছে গুলশান। বিশেষ করে, এই অঞ্চলের বাড্ডা, ভাটারা এবং খিলক্ষেত অংশে অপরাধের মাত্রা উল্লেখযোগ্যহারে বেশি।
১২ লাখ মানুষের আবাসস্থল অপরাধ নির্ভর এই অঞ্চলের মধ্যে বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং ক্যান্টনমেন্ট থানাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ডিএমপির মতে, গত বছর গুলশান ডিভিশনে ৩৩ টি খুনের ঘটনা ঘটে এবং একই সাথে থানায় ৮০ টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং ভাসমান মানুষরা যেখানে থাকছেন, সেসব স্থানেই অধিকাংশ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, মিরপুর অংশে গুলশানের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি মানুষ থাকলেও গত বছর একই সংখ্যক অর্থাৎ ৩৩টি খুনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৫০টি পুলিশ থানা নিয়ে ডিএমপি অপরাধ অঞ্চলকে আটটি বিভাগ বা ডিভিশনে ভাগ করেছে। এই আটটি অংশ হল- রমনা, লালবাগ, ওয়ারি, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান এবং উত্তরা।
গুলশান এবং মতিঝিলের তুলনায় রমনার জনসংখ্যা বেশি হলেও অপরাধ সংঘটনের দিক থেকে রমনার অবস্থা্ন অপেক্ষাকৃত ভাল। গত বছর রমনায় রেকর্ডকৃত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ২৩।
কম বসতিপূর্ণ অঞ্চলে অপরাধের উচ্চ মাত্রাকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ। অপরাধ দমনে তারা এসব অঞ্চলে বিশেষ গুরুত্ব আরোপের কথা বলেছেন। প্রয়োজনে অপরাধের ধরন এবং কারণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
তবে, পুলিশের গুলশান বিভাগের দাবি অনুযায়ী, গুলশান বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় এখানে ব্যবসা এবং চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। এছাড়া, গুলশান ডিভিশনের সব থেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বাড্ডা থানায় খুনসহ অন্যান্য অপরাধের মাত্রা বেশি বলে উল্লেখ করেন তারা।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারীদের মতে, গুলশানের বাড্ডা, সাতারকুল এবং আফতাবনগর অঞ্চলে খুনিদের বেশ কয়েকটি 'কিলার দল' আছে। বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ কিছু সন্ত্রাসী এসব দলের সদস্যদের সঙ্গে গুলশান, বনানী এবং বারিধারা এলাকার স্থানীয় রাজনীতি এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফলে, গুলশানে খুনসহ অন্যান্য অপরাধের মাত্রাও বেড়েছে।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সাধারণত ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চল, বস্তি এলাকা এবং ঢাকার আশেপাশে অপরাধের মাত্রা বেশি।
"গুলশান ডিভিশনের অধীনে অবস্থিত বাড্ডার সাতারকুলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, একই সাথে এখানে বস্তিও আছে। তাই, এখানে অপরাধের মাত্রাও বেশি। আর বাড্ডার কারণেই গুলশানেও অপরাধের মাত্রা বেশি," বলেন তিনি।
ডিএমপির সূত্রানুসারে, রেকর্ড অনুযায়ী রাজধানীতে গত বছর ২১৯টি খুনের ঘটনা ঘটে।এছাড়া খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মাদক এবং অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধের ২২ হাজার ৬৭৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় ৪২ হাজার ৩৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএমপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, লালবাগ ডিভিশনে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সবথেকে কম। গত বছর এখানে ১৫টি খুনের ঘটনা ঘটলেও একই সময়ে এই অঞ্চলে মাদক-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ।
গত বছর এই অঞ্চলে দায়ের করা মাদকদ্রব্য উদ্ধারের মামলার সংখ্যা দুই হাজার ৭০টি।
মাদক উদ্ধার এবং মামলার সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ওয়ারী বিভাগ। গত বছর ওয়ারীতে মাদক সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ছিল এক হাজার ৮৯৯টি।
অন্যান্য অপরাধ অঞ্চলের তুলনায় মিরপুরে হত্যা এবং ধর্ষণের সংখ্যা বেশি কেন এই প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপির মিরপুর ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার মাহাতাব উদ্দীন জানান, জনসংখ্যা বেশি থাকার অপরাধ সংঘটনের সংখ্যাও বেশি।
"মিরপুরে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস করেন। কিন্তু অনেক ডিভিশনে আবাসিকদের সংখ্যা মাত্র ১০ থেকে ২০ লাখ।"
"মিরপুরের অধিকাংশ অধিবাসীই কারখানার শ্রমিক। একটি ঘরে একাধিক পরিবার বাস করে। অনেক সময় পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। তবে, অপরাধ সংঘটিত হলেই পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ দমন করা সম্ভব না। অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে," বলেন তিনি।
অন্যদিকে, লালবাগ ডিভিশনের ডিসিপি বিপ্লব বিজয় তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে মাদক-সংক্রান্ত অপরাধের হার বেশি। এছাড়াও এখানে নিম্ন-আয়ের বহু মানুষ বাস করেন বলেও জানান তিনি। তবে, মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে মাদক-উদ্ধার এবং মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত মামলার হার বেশি বলে দাবী করেন তিনি।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডাকাতি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনা সবথেকে বেশি ঘটে তেজগাঁও অঞ্চলে।
এক বছরে এখানে ৪৫টি ডাকাতি এবং ১৭টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সবথেকে কম ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে উত্তরা অঞ্চলে।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দিক থেকে তেজগাঁও অঞ্চল এগিয়ে আছে।
গত বছর এই অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ২৬টি মামলা দায়ের করা হয়। ২০টি দায়েরকৃত অস্ত্র মামলা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিরপুর।
মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ তত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল কাদের মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ঢাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ থাকেন। তিনি বলেন, "তারা কর্মসংস্থানের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। কিন্তু কাজ পেতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া, রাজধানীতে অপরাধের সাথে জড়িত বিভিন্ন চক্র আছে।"
"গুলশান এখন রাজধানীর বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ফলে, এখানে এক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। নগরের যেসব জায়গায় বস্তি আছে এবং ভাসমান মানুষজন বাস করে, সেখানে মাদক, ছিনতাই এবং অন্যান্য অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। এসব কারণেই অঞ্চলভেদে অপরাধের ধরনে পার্থক্য আছে," বলেন তিনি।