‘ঈদের দিন মা আসবে’, চার বছরের সাদিয়া জানে না মা ভারতে ‘পাচার’ হয়ে গেছেন
রাজধানীর গুলশান পার্কে বাবা ও মামার সঙ্গে ঘুরছিল চার বছরের সাদিয়া ইসলাম। এর আগেও মায়ের সঙ্গে বহুবার এখানে ঘুরতে এসেছে সে। তবে মাস কয়েক হলো মায়ের সঙ্গে আর পার্কে আসা হয় না। মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে উত্তরে বলল, 'আমার মা ডিউটিতে আছে। অনেকদিন ধরে বাড়ি আসে না।'
সাদিয়ার বাসা পার্কের কাছাকাছি কালাচাঁদপুর এলাকায়। তার মা ফাহিমা বেগম। সাদিয়া জানে মা ডিউটিতে। তবে জানা গেছে, ফাহিমা বেগম ডিউটিতে নয়, তাকে পাচার করা হয়েছে। গত ১৪ জুন কেনাকাটার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফাহিমা। এটাই ছিল পরিবারের সঙ্গে তার শেষবারের মতো দেখা। সেদিন থেকেই তিনি নিখোঁজ।
ফাহিমার স্বামী সবুজ কসমেটিকসের একটি দোকান চালান। ওইদিন সকাল ১১টায় তিনি ফাহিমাকে ফোন করেছিলেন। ফোনের আরেক পাশ থেকে ফাহিমা বলেছিলেন, তিনি মেয়ের জন্য বোরখা কিনতে নতুন বাজার যাচ্ছেন। এটাই ছিল ফাহিমার সঙ্গে শেষ কথা। এরপর থেকেই তার নম্বরটি বন্ধ।
২৬ বছর বয়সি সবুজ বলেন, 'আমি বেশ কয়েকবার তাকে ফোন করেছি।'
সবুজ জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় দোকানের কাজে ফাহিমা তাকে সহযোগিতা করতেন।
ফাহিমা যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিনই তার বাবা হারুন অর রশীদ গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। যতই দিন যাচ্ছিল, তাদের ফাহিমাকে ফিরে পাওয়ার আশাও ততই ক্ষীণ হচ্ছিল। তবে হঠাৎই তাদের ফোনে কল আসে।
'জীবিত, ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে'
একদিন সকালে ফাহিমার পরিবারের সদস্যরা ফেসবুকে একটি অপরিচিত অ্যাকাউন্ট থেকে মেসেজ পেতে শুরু করেন। সেখানে বলা হয় তিনি ফাহিমা এবং তিনি ভারতে রয়েছেন।
এর পরে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও ফাহিমাকে না পেয়ে তার পরিবার হতাশ হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি ফাহিমা একটি ফেসবুক আইডি থেকে মেসেঞ্জারে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং জানান যে তিনি ভারতে আছেন।
ফাহিমার বড় ভাই সোলায়মান (২৫) বলেন, 'গত ৩ অক্টোবর ফাহিমা আমার এক কাজিনের সাথে প্রথম যোগাযোগ করে। আমরা জানতে পারি সে বেঁচে আছে।'
ফাহিমার পাঠানো মেসেজের উদ্ধৃতি দিয়ে সোলায়মান বলেন, 'ফাহিমা জানিয়েছিল যে সে ভারতের কালানি নামে একটি জায়গায় আছে। মেসেজে নিজের ছবিও পাঠিয়েছিল সে। পরে ৯ অক্টোবর পাখি নামে একটি আইডি থেকে মেসেঞ্জারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাহিমা।
তিনি বলেন, 'ফাহিমা বলেছিল, তাকে ভারতে পাচার করা হয়েছে এবং প্রায়ই তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ওর সাথে আর আমাদের যোগাযোগ হয়নি।
সোলায়মান বলেন, মেসেজে ফাহিমা জানিয়েছিল যে দুই থেকে তিনজন পুরুষ ও এক নারী সবসময় তার ওপর কড়া নজর রাখছে।
যখন ওই লোকেরা দোকানে কিছু কেনার জন্য কিংবা কোনো কাজে বাইরে যেত, তখনই কেবল তিনি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ পেতেন। তিনি যে বাড়িতে বন্দী ছিলেন, সেটি সেখানকার বাজার থেকে দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছিল।
এরপর ফাহিমার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিবকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানান এবং তার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা কামনা করেন।
ভারতীয় পুলিশের জবাব
গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মারুফ আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ভারতীয় পুলিশের সহযোগিতা চাওয়ার পর তারা [ভারতীয় পুলিশ] ইতিমধ্যেই সাড়া দিয়েছেন। আশা করছি আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে উদ্ধার করতে পারব।'
গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে মামলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভারতের কাছে লিখিতভাবে অনুরোধ জানায়।
পরে ভারতীয় পুলিশ সোলায়মানের সাথে যোগাযোগ করে এবং আইওর সহায়তায় ফাহিমার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেন।
সেই কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে সোলায়মান বলেন, 'এক পুলিশ ২৫ নভেম্বর আমার সাথে কথা বলেছিল। আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে তারা আমার বোনকে উদ্ধার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।'
এ বিষয়ে ভারতের মহারাষ্ট্রের থানে নগর থানার অপরাধ শাখার পুলিশ পরিদর্শক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তিনি জানান, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যবহৃত সিম কার্ডের তথ্য অনুসন্ধান করতে শুরু করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য তারা পাননি।
গুলশান পার্কে সাদিয়ার সঙ্গে আধাঘণ্টা কথা বলার পর ওকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আম্মু কখন ফিরবেন বলে তোমার মনে হয়?
প্রশ্নটি শুনে সাদিয়া চোখে-মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে উত্তরে বলে, 'ঈদের দিন মা আসবে।'