রিজার্ভ চুরির পাঁচ বছর: অর্থ ফেরত আনায় অগ্রগতি নেই
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পাঁচ বছর পেরিয়ে ষষ্ঠ বছর শুরু হলেও ফেরত এসেছে সামান্যই অর্থ। চুরি যাওয়া ৮১.১৯ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ফেরত এসেছে মাত্র ১৪.৬১ মিলিয়ন ডলার। বাকি ৬৬.৫৪ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যে আইনী লড়াই চালাচ্ছে সরকার, তাতেও খুব একটা অগ্রগতি নেই।
২০১৫ সালের ১৬ মার্চ মতিঝিল থানায় রিজার্ভ চুরি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মামলা করেছে, ৫ বছরেও তার তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে সিআইডি জানিয়েছে, তদন্তের কাজ প্রায় শেষের দিকে। শীগগিরই আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।
রিজার্ভ চুরির রহস্য উদঘাটনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির রিপোর্টটিও আর প্রকাশ করা হয়নি। ২০১৬ সালের মে মাসে কমিটি প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছিল।
সার্বিকভাবে রিজার্ভ চুরির বিষয়টি এখনো রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
অর্থ উদ্ধারে আইনী লড়াই
৬৬.৫৪ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারে নেয়া পদক্ষেপের বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্যে, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মধ্যে ২৯শে জানুয়ারী, ২০১৯ এ একটি ''রেজোলিউশন অ্যান্ড এসিসট্যান্স এগ্রিমেন্ট ' স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ৭ জন ব্যক্তি, ২০টি প্রতিষ্ঠান এবং ২৫ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০১৯ এর ৩১শে জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ জেলা আদালতে মামলা দায়ের করেছিল।
২০২০ সালের ২০ মার্চ আদালত মামলাটি খারিজ করে দিয়ে অন্য আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়। এ প্রেক্ষিতে গেল বছরের ২৭ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্টে নতুন আরেকটি মামলা দায়ের করে। মামলা দায়েরের পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতি নেহায়েতই সামান্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইনটিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজি হাসান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'নিউয়র্কের আদালত থেকে আসামি বরাবর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। স্বল্প সময়ের ভিতরে মামলার শুনানি শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদী। তবে ঠিক কবে নাগাদ শুরু হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি'।
রাজি হাসান জানান, 'রিজার্ভ যেহেতু পাবলিক মানি, তাই অর্থ ঊদ্ধারে সরকার মামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে'।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নিউইয়র্কের আদালতে মামলা দায়েরের পর ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশেনে (আরসিবিসি) ওই বছরের ৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ফিলিপাইনের একটি আদালতে পাল্টা মানহানি মামলা করেছিল।
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, রির্জাভ চুরির সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত। তদন্তের জন্য পাঁচটি দেশের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। ফিলিপাইন ও ভারত তথ্য দিলেও উত্তর কোরিয়া, চীন ও শ্রীলঙ্কা থেকে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ঘটনার বাংলাদেশ অংশের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ঘটনার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকের সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দায়িত্বরত ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকের দায়িত্বে অবহেলারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ জন্য তাদেরকেও অভিযুক্ত করা হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'চার্জশিটে বাংলাদেশ অংশের জড়িত সবাইকে অভিযুক্ত করা হবে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান প্রভাবশালী অনেকের নাম থাকবে'।
তিনি বলেন, 'এই চুরি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা আছে। অনেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনও করেননি। এটা হতে পারে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। তবে যেটাই হোক তারা সবাই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাদের কাছে এমন আচরণ আশা করা যায় না। তারা তাদের দায় এড়াতে পারেন না'।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল টিবিসকে বলেন, 'তদন্ত প্রায় শেষ। যে কোন সময় চার্জশিট দেয়া হবে'। কতজনকে অভিযুক্ত করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তদন্ত শেষ হোক। তখন বলা যাবে'।
ফরাসউদ্দিন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন
রিজার্ভ চুরির ঘটনা মার্চের শুরুতে প্রকাশের পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বের তিন সদস্যদের তদন্ত কমিটির গঠন করে দিয়েছিল অর্থমন্ত্রণালয়।
কমিটি ওই বছরের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একটি অন্তবর্তী প্রতিবেদন এবং ৩০ মে নির্ধারিত ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়।
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ১৫-২০ দিনের মধ্যেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে। এটা তার প্রতিজ্ঞা। প্রতিজ্ঞার পর ৫ বছর পার হয়েছে। মন্ত্রীও আর দায়িত্বে নেই। তদন্ত রিপোর্ট আর প্রকাশ হয়নি। তাতে এখনো অজানাই রয়ে গেছে রিজার্ভ চুরির রহস্য।
যা ঘটেছিল
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নিউইয়র্ক শাখায় থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন ডলার লোপাট হয়। অর্থ লেনদেনের আন্তজার্তিক মাধ্যম সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম হ্যাক করে এই অর্থ চুরি করে অজানা হ্যাকাররা। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হ্যাকিংয়ের ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-এফবিআই এই সাইবার হামলার তদন্ত করে জানতে পারে, পার্ক জিন হিয়ক-নামে উত্তর কোরিয়ার এক নাগরিক এর জন্য দায়ী।
সংস্থাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ইলেকট্রনিক তথ্য-প্রমাণাদি থেকে জানতে পায়, রিজার্ভ চুরির জন্য সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করতে মূলত চারটি ইমেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছিল হ্যাকাররা।
চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কায় চলে গেলেও তা ফেরত আনা সম্ভব হয়। বাকি ৮১.১৯ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) পাঁচটি ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ফিলিপাইনের কয়েকটি ক্যাসিনো ঘুরে বেহাত হয়ে যায়।
এই ঘটনায় ফিলিপাইনের সিনেটে শুনানির পর আরসিবিসি ব্যাংককে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ বিলিয়ন পেসো বা ২০.৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করে।
পরবর্তীতে এক মামলায় ব্যাংকটির মাকাতি শাখার সাবেক ম্যানেজার দেগুইতোকে ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেয় ফিলিপাইনের আদালত। একই সঙ্গে তাকে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানাও করা হয়।
সিনেটের শুনানিতে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকারের পর ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং-এর কাছ থেকে ১৫.১২ মিলিয়ন ডলার জব্দ করা হয়েছিল।
এদিকে, ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরি হলেও তা গোপন রেখেছিলেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। রিজার্ভ চুরির দায় নিয়ে তিনি ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন।
একই দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম খান ও নাজনীন সুলতানাকে অব্যাহতি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব এম আসলাম আলমকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়।
মার্চের শুরুতে চুরির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর র্যাবের একটি ছায়া তদন্ত দল প্রাথমিকভাবে তদন্ত করেছিল। পরে সাইবার আক্রমণের ফরেনসিক তদন্ত করেছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন আইটি উপদেষ্টা, ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা।