রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে শঙ্কা, অবকাঠামো নির্মাণে সমন্বয়ের অভাব
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সময়মতো উৎপাদন শুরু হলেও, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুসারে, পরমাণু কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের কাজ এগিয়ে চললেও তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে সঞ্চালন লাইন, টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ। একই গতিতে কাজগুলো অগ্রসর না হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা।
এপ্রিলের শুরুতে প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শনের ওপর প্রতিবেদনটি নির্মিত হয়। সময়মতো কেন্দ্রের নির্মাণ স্থাপনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিবিধ কাজ সম্পন্ন করাকে বর্তমানে প্রকল্পের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসবে উল্লেখ করা হয় এই প্রতিবেদনে।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ দুটি আঙ্গিকে চলছে। এর মধ্যে একটি হল রাশিয়ার সাথে চুক্তিনির্ভর টার্নকি পরমাণু প্ল্যান্ট নির্মাণ। রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানের সাথে নির্ধারিত চুক্তি অনুসারে ২০২৫ সাল নাগাদ প্রকল্পের মূল অংশ নির্মাণ শেষ হবে।
কিন্তু, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই লিমিটেড এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিচালিত কাজ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুসারে, সেই অনুযায়ী ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্প অঞ্চলে ১০০ মেগাওয়াট ব্যাকফিড বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জ্বালানি বোঝাই সম্পন্ন হবে। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসারে, জ্বালানি বোঝাইয়ের অন্তত দুই থেকে তিন মাস আগে গ্রিড ব্যবস্থার নির্মাণ সম্পূর্ণ হতে হবে। সে অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ কেন্দ্রের উপযোগী গ্রিড ব্যবস্থা নির্মাণ করতে হবে।
কিন্তু, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের গ্রিড এবং অন্যান্য সহযোগী কাজ লক্ষ্যপূরণে পিছিয়ে আছে। বিশেষ কর্মপরিকল্পনা নির্মাণের মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করে প্রতিষ্ঠানটিকে দ্রুত কাজ শেষ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।
কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটিতে ভারতীয় ঋণচুক্তি এলওসির আওতায় গৃহীত ১৬০ কোটি ডলারের অর্থায়ন আছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণেও ঋণ সহায়তা ব্যবহৃত হচ্ছে।
এলওসির শর্ত অনুসারে, টেন্ডারের কাগজপত্র তৈরি ও ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে নতুন করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন প্রক্রিয়ার কারণে সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণে বিলম্বের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের একাধিক সূত্র।
প্রকল্পের অধীনে, চারটি প্যাকেজে ৪৬৪ কিলোমিটারের ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ চলছে। এর মধ্যে রূপপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার, রূপপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার, রূপপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১৪৭ কিলোমিটার এবং আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মিত হবে।
এছাড়া, পদ্মা নদীতে ছয় কিলোমিটার এবং যমুনা নদীতে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানান, টেন্ডার প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পর জানুয়ারি এবং মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ঠিকাদারদের সাথে সবগুলো প্যাকেজের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ১৫ শতাংশ।
তবে, কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ প্রায় থেমে গেছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
মহামারি দীর্ঘায়িত না হলে প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া।
"নদীর উপর লাইন ব্যতীত অন্যান্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য আমরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। বাঘাবাড়ী থেকে আসা ব্যাকফিড সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। আমরা চলতি বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি," বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে অবস্থিত বিভিন্ন অংশীদারদের সাথে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড। সাধারণ কার্যপরিচালনা ছাড়াও জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে।
২০২২ সালে জ্বালানি বোঝাইয়ের আগেই কাজটি শেষ করতে হবে। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুসারে, মূল কেন্দ্রের কাজের পাশাপাশি এই কাজগুলোর অগ্রগতির জন্য সম্মিলিত কর্ম পরিকল্পনা নির্মাণ প্রয়োজন।
এখন পর্যন্ত এই কাজের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
তবে, ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে জানান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল মতিন। নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী কাজ সমাপ্ত হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
"আমরা ইতোমধ্যে খসড়া প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে এই প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয়েছে। গত ৭ মার্চ নির্বাচন কমিটির সাথে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটি আমাদের সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান করেছে," বলেন তিনি।
মোহাম্মদ রফিকুল মতিন আরও জানান, "সবকিছু ঠিকমতো চললে, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে, আগামী অর্থ বছরের শুরুতে প্রকল্পের কাজ আরম্ভ করবে।"