লক্ষ্মীপুরে ট্রলার তৈরিতে হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান
উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে তৈরি হচ্ছে সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলারসহ মাছ ধরার সব ধরনের ট্রলার ও নৌকা। সমুদ্রগামী ট্রলারগুলো আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে। এতে অর্থসাশ্রয়ের পাশাপাশি বছরে শতাধিক সমুদ্রগামী ট্রলার ও তিন শতাধিক নৌকা তৈরিতে স্থানীয় প্রায় ২-৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর এ শিল্পে বছরে প্রায় ২শ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলায় ট্রলার ও নৌকা তৈরির কয়েকটি স্থানে গিয়ে কারিগর, মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। এসময় কারিগররা জানায়, লক্ষ্মীপুরে ট্রলার তৈরি শিল্প বিকশিত হলে আরো কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
জেলার রামগতি উপজেলার টাংকি বাজার, চরগাজী, আলেকজান্ডারের আসলপাড়া, আলেকজান্ডারঘাট,কমলনগরের মতিরহাট,ভাঙ্গাপুল,জারিদোনা, লুধুয়া ফলকন,পাটোয়ারিরহাট,সদরের মজুচৌধুরীরহাট, বেঁড়িমাথা,রায়পুরের চর বংশী এলাকাসহ উপকূলীয় ৪ উপজেলার প্রায় ১৩টি স্থানে সমুদ্রগামী ও নদীর ফিশিং ট্রলার তৈরি হয়।
রামগতি উপজেলার চর রমিজ এলাকার হোসেন মিস্ত্রি জানান, নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত ট্রলার ও নৌকা তৈরির মৌসুম। শুকনো মৌসুম ছাড়া নৌকা তৈরি করা যায় না। আবার বর্ষা মৌসুম হচ্ছে মাছ ধরার মৌসুম। তখন নৌকা তৈরি বা মেরামত হয় না। ট্রলার ও নৌকা তৈরির কারিগররা জানায়, একটি ট্রলার তৈরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ অতিবাহিত করতে হয়। প্রতিটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার সাত থেকে দশজন কারিগর দরকার পড়ে। এভাবে প্রতিটি এলাকায় প্রায় দেড়শ থেকে দুইশ লোকের কর্মসংস্থান হয়।
স্থানীয় কারিগররা জানায়, ট্রলার বানানোর কাজ শুরু করেন কাঠ মিস্ত্রি। কাঠ মিস্ত্রি গলুই, চান্দিনা, ছই, রান্নাঘর, পায়খানা তৈরি করে। কাঠের জোড়ার ফাঁকে সুতার সলতে ঢুকানো বা 'গাইনির কাজ' করে আরেক দল। গাইনির কাজের পর কেরোসিন তেলের সঙ্গে ধূপ ও পানি মিশিয়ে শুরু হয় পুটিংয়ের কাজ। পরে ট্রলারের নিচের অংশে আলকাতরা লাগাতে হয়। এরপর ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগানো হয় পেছনের পাখা বসানো হয়। সবশেষে করা হয় রঙের কাজ।
আলেকজান্ডারের আসলপাড়ায় কথা হয় ট্রলার তৈরির মিস্ত্রি আবুল খায়েরের সাথে, তিনি জানান সমুদ্রগামী প্রতিটি ট্রলার তৈরিতে প্রায় ৫ মাস সময় লাগে। একটি ট্রলার তৈরিতে কাঠের প্রয়োজন পড়ে কমপক্ষে ১২শ ঘনফুট এবং তৈরি বাবদ খরচ হয় ৭-৮ লক্ষ টাকা। আর প্রতিটি ট্রলারে ইঞ্জিন ও জালসহ খরচ পড়ে ৮০ লাখ থেকে প্রায় কোটি টাকা। সমুদ্রগামী ট্রলারগুলো ৫৬ ফুটের বেশি লম্বা এবং প্রায় সাড়ে ১৬ ফুট প্রস্থের হয়। এসকল ট্রলার তৈরিতে আমদানি করা বিদেশী কাঠ ব্যবহৃত হয়। তিনি আরো জানান, আগে মালিকরা থাইল্যান্ড, মিয়ানমার থেকে এ সকল ট্রলার কিনে আনত। বর্তমানে বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়, এতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং অর্থ পাচারও রোধ হচ্ছে।
মনির নামের অপর এক মিস্ত্রি জানান, সমুদ্রগামী একটি ট্রলার তৈরিতে ৬শ থেকে ৭শ রোজ শ্রমিক লাগে। অন্যদিকে ছোট কিংবা মাঝারি নৌকা তৈরিতে সময় লাগে ১ থেকে ২ মাস। এতে প্রায় ৩শ রোজ শ্রমিক লাগে; খরচ পড়ে ২০-২৫ লাখ টাকা।
জাহাঙ্গীর মিস্ত্রি জানান, কমলনগরের মতিরহাট এলাকা থেকে বছরে প্রায় ১০টি সমুদ্রগামী ট্রলার তৈরি হচ্ছে। একই সময়ে সেখানে আরো ২০টি নৌকা তৈরি হয়।
জেলার বিভিন্ন স্থানের ট্রলার মিস্ত্রিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বছরে শতাধিক সমুদ্রগামী ট্রলার তৈরি হয়ে থাকে। আর একই সময় নৌকা তৈরি হয় আরো তিনশতাধিক। এসব ট্রলার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাছ ধরার উপযোগী।
মতিরহাটে নৌকার মালিক এমরান জানান, আমদানিকৃত কাঠের তৈরি ট্রলার প্রায় ১৫-২০ বছর অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে দেশীয় কাঠের তৈরি ট্রলার ৮-১০ বছর টিকে। খরচ পড়ে অর্ধেক। সমুদ্রগামী ট্রলার তৈরিতে বিদেশী লোহা কাঠ, ওক এবং চাপালিশ কাঠ ব্যবহার করা হয়। আর ছোট নৌকা তৈরিতে দেশীয় মেহগনি, চাপালিশ, রেইনট্রি কড়ই, নলকড়ই, পুনাল, নাড়াই, গর্জন, চাম্বল, ত্রিশূল শিশুগাছ ব্যবহৃত হয়।
আলেকজান্ডার ল ঘাটে গিয়ে দেখা যায় সেখানে সমুদ্রগামী পাঁচটি বড় ট্রলার তৈরি প্রায় শেষ। এ ট্রলারগুলোতে ইঞ্জিন বসানো ও রং দেয়াসহ সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। ট্রলারগুলোতে ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে শ্রমিকরা কাজ করছেন।
ট্রলার তৈরির কারিগর বেলায়েত মাঝি জানান, তিনি এ পেশায় আছেন ৩০ বছর ধরে। ট্রলার তৈরিতে যোগ্যতাসম্পন্ন একজন শ্রমিক প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২শ' টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। আর সহকারী শ্রমিকরা ৫শ' থেকে ৭শ' টাকা। যেদিন ট্রলার সমুদ্রে কিংবা নদীতে যায় সেদিন জেলেদের যেন ঈদ। ট্রলারে আয়োজন হয় ধর্ম অনুযায়ী নানা প্রার্থনা। কারিগর এবং জেলেদেরকে ভালোভাবে একবেলা খাওয়ানো হয়। মিস্ত্রিদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রতিটি ট্রলার বা নৌকার সাথে একটা আনন্দ জড়িয়ে থাকে।
শ্রমিকরা জানালেন, সমুদ্রগামী ট্রলারগুলো দ্রতগতিসম্পন্ন হয়। উত্তাল সমুদ্রের প্রতিকূলে স্রোতের মাঝেও ঘণ্টায় ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার এবং অনুকূলে ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। চায়নাসহ বিদেশী আমদানি করা কোম্পানীর নতুন ও রিকন্ডিশনড ১৪০ থেকে ২৯০ হর্স পাওয়ারের শক্তিশালী ইঞ্জিন ট্রলার ও নৌকাতে বসানো হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো: বিলাল হোসেন জানান, জেলায় অনুমোদিত সরকারি বা বেসরকারি কোন ডকইর্য়াড নেই। যে ট্রলারগুলো তৈরি হচ্ছে, তা স্থানীয়দের উদ্যোগেই তৈরি হয়। তিনি আরো জানান, ট্রলার তৈরিকে শিল্প হিসেবে রূপ দিতে পারলে স্থানীয়রা আরো উন্নতমানের ট্রলার তৈরি করতে পারবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর সীমানা রয়েছে ৮৮ কিলোমিটার। যেখানে প্রায় ১ লাখ অধিবাসী মৎস্য শিকারের সাথে জড়িত। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে নিবন্ধিত মৎস্যজীবির সংখ্যা ৫০ হাজার ২শ ৫২ জন। যার মধ্যে ৪০ হাজার রয়েছে ইলিশজীবি। ইলিশজীবি জেলের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার জেলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় গিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরে। প্রত্যেকটি ট্রলারে প্রায় ১২ থেকে ১৮ জন জেলে থাকেন।
জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আরো জানিয়েছেন, সমুদ্রগামী ট্রলার সমুদ্রে যাওয়ার আগে নিতে হয় মাছ ধরার ট্রলার পরিচালনার জন্য বিশেষ লাইসেন্স। সমুদ্রগামী ট্রলারের লাইসেন্স দেয় চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার মৎস্য বিভাগ থেকে। আর নদীতে মাছ ধরার নৌকার লাইসেন্স দেয় সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে প্রায় ৩ হাজার অনুমোদিত ফিশিং ট্রলার রয়েছে বলেও জানান তিনি।