শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিদায়
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিদায় জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। রোববার সকালে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে তাকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন হাজারো শুভাকাঙ্খী ও গুণগ্রাহী।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শুরুতেই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে মেজর আশিকুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে উপ সামরিক সচিব কর্নেল মো. সাইফুল্লাহ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
রোববার (২২ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় তার মরদেহ আনা হয়। দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ আর্মি স্টেডিয়ামে রাখা হয়। দুপুরেই এখানে স্যার ফজলে হাসান আবেদের জানাজা সম্পন্ন হয়। পরে বনানী কবরস্থানে এ বরেণ্য ও আলোকিত ব্যক্তিত্বকে দাফন করা হয়।
স্যার ফজলে হাসান আবেদকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষদের জন্য আর্মি স্টেডিয়ামে বিশাল প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়। স্টেডিয়ামে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও ব্র্যাক, আড়ং, ব্র্যাক ব্যাংক ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্বেচ্ছাসেবীরা শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মরণে আজ রোববার দুপুর ২টা থেকে মহাখালীস্থ প্রধান কার্যালয় ব্র্যাক সেন্টারে একটি শোকবই খোলা হবে। এছাড়া আড়ং, ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীকাল সোমবার এবং সারাদেশে ব্র্যাকের আঞ্চলিক অফিসগুলোতে আগামী মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শোকবই খোলা থাকবে। শোকবই থাকবে ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ গত শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর বসুন্ধরার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি রেখে গেছেন।
ফজলে হাসান আবেদের জীবন
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন ভূস্বামী। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ওই অঞ্চলের জমিদার।
আবেদ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ও পরে ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
তবে হবিগঞ্জে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন।
এরপর তিনি চাচার চাকুরিস্থলে কুমিল্লা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন।
এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সঙ্গে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন।
১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন নটরডেম কলেজ থেকে। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দু’বছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। এখানে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের উপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স পাস করেন ১৯৬২ সালে।
এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস ইউনিভার্সিটি থেকে 'ডক্টর অব ল' এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে 'ডক্টর অব এডুকেশন' ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াশোনা করার সময়ে ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে সেখান থেকে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে তিনি শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগদান করেন। এখানে চাকরির সময় সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। ফজলে হাসান আবেদ উপদ্রুত এলাকা মনপুরায় গিয়ে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেন। এর চার মাস পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি।
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা
১৯৭০ সালে ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত দুঃস্থ মানুষের সাহায্যে ত্রাণ কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। যুদ্ধের পর সিলেটের শাল্লায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনকে দেখতে গেলেন। সেখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি শাল্লায় কাজ করবেন। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের দরিদ্র, অসহায়, সব হারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে শুরু করলেন “Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee” সংক্ষেপে যা “BRAC” নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্র্যাকের জন্ম হলো।
১৯৭৩ সালে সাময়িক ত্রাণ কার্যক্রমের গণ্ডি পেরিয়ে ব্র্যাক যখন উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে, তখন “BRAC”-এই শব্দসংক্ষেপটির যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, সেটি হল “Bangladesh Rural Advancement Committee”। বর্তমানে ব্যাখ্যামূলক কোনো শব্দসমষ্টির অপেক্ষা না রেখে এই সংস্থা শুধুই “BRAC” নামে পরিচিত।
কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ, এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হয়।
বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি সুফিয়া কামাল হলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। চলতি বছর ৮৩ বছর বয়সে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তাকে প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস চেয়ার নির্বাচিত করা হয়।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাসহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার ১২টি দেশে এটির কার্যক্রম রয়েছে। ব্র্যাক এর দাবি অনুযায়ী বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠানে এক লক্ষের মত কর্মী কাজ করে থাকেন। তবে এদের মধ্যে ৭০ ভাগই নারী কর্মী। ব্র্যাকের পরিসেবার আওতায় আছে ১২৬ মিলিয়ন লোক।
পুরষ্কার
ফজলে হাসান আবেদ তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে অন্যতম হলো-সামাজিক নেতৃত্বের জন্য র্যামন ম্যাগসেসে পুরষ্কার (১৯৮০), ইউনেস্কা নোমা পুরষ্কার (১৯৮৫), এ্যালান শন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরষ্কার (১৯৯০), লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল (২০১৪), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পুরস্কার (২০১৫) জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার, গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার ইত্যাদি। সর্বশেষ চলতি বছর তিনি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সাউথ এশিয়ান ডায়াসপোরা অ্যাওয়ার্ড, শিক্ষায় ভূমিকা রাখায় ইয়াডান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
এছাড়া নেদারল্যান্ডসের রাজার পক্ষ থেকে নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অফ অরেঞ্জ-নাসাউ’ খেতাবেও ভূষিত হন তিনি।