সাধারণ জেলে হাবিব ৭০ বাঘের দুর্ধর্ষ শিকারি!
হাবিবের বাবা সুন্দরবনে মাছ ধরতেন। বাবার সঙ্গে মাছ ধরার মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের সঙ্গে হাবিবের পরিচয়। পরে হাবিব একাই মাছ ধরেছেন বহু বছর। মাছের চেয়ে হরিণের মাংস ও চামড়ার দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণে এ সময়ে সে হরিণ শিকারও শুরু করে।
হরিণ শিকারে সিদ্ধহস্ত হওয়ার পর সুন্দরবন কেন্দ্রিক হরিণ, বাঘ শিকার চক্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে তার। দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবন ঘিরে বাঘ-হরিণসহ অন্য বন্য প্রাণি হত্যা ও এদের চামড়া, হাড়-গোড়, দাঁতসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ চড়া দামে বিক্রিতে গড়ে ওঠা চক্র সক্রিয় বহু বছর ধরেই। এদের মাধ্যমেই সুন্দরবনের হরিণ, বাঘের চামড়া হাড়গোড়, পশু পাখিএগুলো দেশের বাইরে পাঁচার হয়ে আসছে। তবে এই প্রভাবশালী চক্র বরাবর আইনের বাইরেই থেকে গেছে।
৭০টি বাঘ শিকারের অভিযোগে গেল শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার হয় হাবিব। হরিণ শিকারে পরিণত হওয়ার পর হাবিবের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রজু হয়েছে। বন বিভাগ ও থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী বাঘ হাবিবেরর নামে ৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বাঘ হত্যার দায়ে ৩টি, হরিণ হত্যার দায়ে ৫টি এবং বন অপরাধে আরও একটি মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে তিনটি মামলায় ওয়ারেন্ট ছিল তার নামে।
হাবিবের বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে, বাবার নাম কদম আলী তালুকদার। বাবা কদম আলী তালুকদারের একসময় মূল পেশা ছিল মাছ ধরা।পরে জেলে থেকে সুন্দরবনের দস্যুতায় লিপ্ত হন তিনি। আটক হয়ে জেলও খাটে। জামিনে মুক্তি পেয়ে পরে বাড়িতেই থাকতেন। চার বছর আগে মারা যান কদম আলী।
দুস্য বাবার ছেলে হলেও হাবিব এমন দুর্ধর্ষ বাঘ শিকারি, ৭০টির উপরে বাঘ মেরেছে এলাকার লোকজন তা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। তাদের কাছে হাবিব নিতান্তই সহজ সরল, হাবাগোবা প্রকৃতির মানুষ।
তবে হাবিব গল্পছলে বাঘ মারার কথা বলেছেন লোকজনের কাছে, কিন্তু খুব কম মানুষই তার গল্প বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু শুক্রবার হাবিব তালুকদার (৫০) ওরফে হাবিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর গ্রামবাসী ও তাকে যারা চিনত তাদের চোখ কপালে উঠেছে। হাবাগোবা হাবিবকে তারা নতুন চোখে দেখছেন। হাবিব এখন রাতারাতি এলাকায় বাঘ হাবিব নামে পরিচিতি পেয়ে গেছেন।
তবে হাবিব নিজে নানা আড্ডায় নিজমুখে গল্পছলে বলেছেন তিনি ৩২টি বাঘ মেরেছেন। তবে বাগেরহাট আদালতের হাজত খানায় কথা হয় হাবিবের সাথে, হাবিব বলেন, ছোট বেলা থেকে বাবার সাথে সুন্দরবনে যেতাম। মাছ ধরতাম। অন্য কোন আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় আমরা সবাই বনের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। এক পর্যায়ে হরিণ শিকার করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে মাংস বিক্রি শুরু করি। কয়েক বছর এ কাজ করার পরে আইনের ভয়ে আর শিকার করি নাই। তিনি আরও বলেন, আমাদের এলাকায় আরও ২০-২৫টি পার্টি রয়েছে, যারা বন্য প্রাণি শিকার করে। আমাকে পরিকল্পিত ভাবে ফাঁসিয়েছে তারা।
এছাড়া যারা প্রকৃত পক্ষে শিকারের সাথে জড়িত, তাদের আত্মীয়দের সাথে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ভাল সম্পর্ক রয়েছে বলেও দাবি করেন হাবিব।
হাবিব প্রভাবশালী একটি চক্রের অনুগত ও শিকার এ বিষয়ে এক মত সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যোন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, "সুন্দরবন কেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত অপরাধী হাবিবরা মাঝেমধ্যে এরকম আইনের আওতায় আসে। আবার একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আইনগতভাবেই মুক্তি পেয়ে যায় তারা। কিন্তু হাবিব বা স্থানীয় অপরাধীরা কাদের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে বাঘ-হরিণসহ বন্য প্রাণি হত্যা করছে তা এখনও অজানা। বাঘের চামড়া, হাড়-গোড়, দাঁতসহ বিভিন্ন অঙ্গ দেশের বাইরে পাচার হয়। চড়া দামে বিক্রি হয়। হাবিবরা তো সুন্দরবন থেকে বাঘ মেরেই শেষ। কিন্তু যাদের মাধ্যমে হাবিবরা বাঘ হত্যায় উৎসাহ পাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ রয়েছে বলে আমার জানা নেই।"
হাবিব এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, বাঘ শিকারের সঙ্গে যারা আসলে জড়িত, তাদের আত্মীয়দের সাথে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে।
তবে হাবিব স্বীকার করেছেন, বাঘের প্রতি তার ক্রোধ রয়েছে। হাবিব বনে মাছ শিকার করতে গিয়ে বাঘের পাল্লায় পড়েছিলেন একবার। তার বয়ানে ঘটনা অনেকটা এরকম-দুই বছর আগে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের লাঠিমারা এলাকায় বনের মধ্যে একটি বাঘকে শুয়ে থাকতে দেখেন। বাঘটির শোয়ার ভঙ্গিতে তার ধারণা হয়, বাঘটি মৃত। মৃত ভেবে কাছে গিয়ে বাঘের গায়ে হাত দেওয়ামাত্র বাঘের আক্রমণের মুখে পড়ে যান হাবিব। ভাগ্যক্রমে বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে যান সে যাত্রায়। তারপর থেকেই বাঘের প্রতি তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয় তার।
তার ঘনিষ্ট কিছু মানুষ জানেন হাবিবের বাঘের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবের কথা। এই গল্প যারা জানেন তাদের কাছে হাবিব তখন থেকেই বাঘ হাবিব। কিন্তু তা বাঘ মারার জন্য নয়, বাঘের শিকার হয়ে বেঁচে ফেরার জন্য।
সোনাতলা গ্রামের ইউপি সদস্য ডালিম হোসেন হাবিবকে চেনেন বহু দিন ধরে। তিনি বলেন, "গেল দশ বছর দরে আমি ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার জানামতে হাবিব একজন সুন্দরবনের বন্য প্রাণি শিকারি। দীর্ঘদিন ধরে হরিণ শিকার করে এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে আসছে। তার ছেলে হাসান হাওলাদার ও মেয়ের জামাতা মিরাজ ঘরামীও এই শিকারের সাথে জড়িত। তবে দুই এক বছর ধরে শুনেছি হাবিব বাঘও হত্যা করেছে। তবে কেমন সংখ্যক বাঘ হত্যা করেছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারি না। পুলিশ তাকে ধরার জন্য আমার সহযোগিতাও চেয়েছে। অনেকদিন ধরে হাবিব এলাকা ছাড়া ছিল। মাঝেমধ্যে গোপনে আসত।"
সুন্দরবন সুরক্ষায় নিয়োজিত কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপের (সিপিজি) ভোলা টহল ফাঁড়ি ইউনিটের দলনেতা মো. খলিল জমাদ্দার বলেন, "গেল দুই বছর আগে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের লাঠিমারা এলাকায় ভাগ্যক্রমে বাঘের আক্রমন থেকে বেঁচে যায় হাবিব। এর পর থেকে এলাকার মানুষ তাকে বাঘ হাবিব বলে ডাকে।"
তিনি আরও বলেন, "হাবিব একটু হাবাগোবা ধরনের মানুষ, ও আমার প্রতিবেশী। লোভে পড়ে সে কিছু বন্য প্রাণি শিকার করেছে। কিন্তু আসলে সে কত সংখ্যক বাঘ ও হরিণ শিকার করেছে জানি না। তবে আমি মনে করি বনের মধ্য থেকে বাঘ হত্যা খুবই কঠিন কাজ। হাবিবকে আমি বুঝিয়েছি যে বনের কোন প্রাণি শিকার করা যাবে না। এসব কথার মাঝেই হাবিব একদিন আমাকে বলেছে সে ৩২টি বাঘ হত্যা করেছে। এরমধ্যে ১৯টি মাদি বাঘ। কিন্তু এসব বাঘ হত্যা করে হাবিব কি করেছে জানি না।"
তবে যে হাবিব ৭০টি বাঘের এত বড় শিকারী, হাবিবের বাড়ি গেলে তা বোঝার উপায় নেই। খুবই দীনহীন। দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা। বাঘ শিকারের সঙ্গে জড়িত থাকলেও হাবিবের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেনের মতে, "হাবিব আসলে এ পর্যন্ত কয়টি বাঘ হত্যা করেছে তা স্পষ্ট না। হাবিবের নামে তিনটি বাঘ হত্যার মামলা রয়েছে। মামলার পরেই সুন্দরবনে হাবিবের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।"
তিনি আরও বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রতঙ্গের উচ্চ মূল্য রয়েছে। যার ফলে একটি আন্তর্জাতিক চক্র বাঘের চামড়াসহ বিভিন্ন অঙ্গ পাচার ও ক্রয় বিক্রয়ের সাথে জড়িত রয়েছে। এই চক্রটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে সুন্দরবনের জেলেদের ব্যবহার করে থাকে। আমরা বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের মাধ্যমে অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।"
শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইদুর রহমান বলেন, "বাঘ হাবিবের নামে শরণখোলা থানায় তিনটি ওয়ারেন্ট মুলতবি ছিল। তাকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সোর্সের মাধ্যমে তার অবস্থান শনাক্ত করে গত শুক্রবার তাকে আটক করি। শনিবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে হাবিবকে।"