সিলেটের হোটেল-রিসোর্ট এখন সবচেয়ে বড় সঙ্কটে
বছর দুয়েক আগে শ্রীমঙ্গলের রাধানগর এলাকায় একটি দ্বিতল বাসা ভাড়া নিয়ে 'হিমাচল' নামে একটি ছোট রিসোর্ট চালু করেছিলেন ঢাকার বাসিন্দা আজিজুর রহমান সাজু। ব্যবসা ভালোই চলছিল। তবে সব ওলট-পালট করে দেয় করোনাভাইরাস। প্রায় চার মাস ধরে পুরো বন্ধ রিসোর্ট। আয় নেই। তবু বাসা ভাড়া-বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। বেশিরভাগ স্টাফকে ছুটি দিয়ে দিলেও ভবন তদারকির জন্য দুয়েকজনকে রাখতে হয়েছে। তাদেরও বেতন দিতে হচ্ছে।
আজিজুর রহমান সাজু বলেন, মাসে আমার প্রায় এক লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এভাবে মাসের পর মাস চালানো সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে রিসোর্টটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আজিজুর রহমানের মতোই ভালো নেই হোটেল খাতের বড় উদ্যোক্তা সুমাত নুরী জুয়েল। সিলেট নগরীর নয়াসড়ক এলাকায় ফরচুন গার্ডেন নামে একটি হোটেল রয়েছে তার। ওই হোটেল ভবন নির্মাণের জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন। এখন ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। আবার পুরনো ঋণ থাকায় নতুন ঋণ পাচ্ছেন না তিনি।
সুমাত নুরী জুয়েল বলেন, সরকার থেকে প্রণোদনা প্রদানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রণোদনা পাচ্ছে কারা।
''আমাদের যাদের আগের ঋণ রয়েছে তাদেরকে তো ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না। আবার ঋণ নিলেও পরিশোধ করবো কি করে। ব্যবসা তো নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেবে'', বললেন নুরী জুয়েল।
কেবল এই দু'জনই নয়, এমন অভূতপূর্ব সঙ্কটে রয়েছেন সিলেটের হোটেল-রিসোর্টখাতের সব উদ্যোক্তাই। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবছেন।
প্রবাসীবহুল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেট। এ অঞ্চলের মানুষের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে অনাগ্রহের বিষয়টিও আলোচিত। তবে গত এক-দেড় দশকে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এনেছে হোটেল-রিসোর্ট খাত। এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা।
এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। কেবল শ্রীমঙ্গল শহরেই গত পাঁচ বছরে গড়ে উঠেছে শতাধিক রিসোর্ট। পর্যটনখাতকেই সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছিলেন সংশ্লিস্টরা।
পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত সিলেটে গত এক দশকে পর্যটকও সমাগম বেড়েছিল আশাব্যঞ্জক হারে। ছুটির দিনগুলোয় কোনো হোটেল-রিসোর্টের কক্ষ খালি পাওয়া যেত না। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন হোটেল-রিসোর্টের উদ্যোক্তরা। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাতই এখন সবচেয়ে সঙ্কটে। ইতোমধ্যে হোটেল-রিসোর্ট খাতের ৯০ শতাংশ কর্মীকে বিনাবেতনে ছুটিতে পাঠিয়েছেন উদ্যোক্তরা।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব। নগরীতে তার নিজেরও হোটেল ব্যবসা রয়েছে। শোয়েব বলেন, সিলেটে তেমন ভারী শিল্প-কারখানা নেই। ট্রেডিং, পর্যটন আর আমদানি-রফতানিই এখানকার প্রধান ব্যবসা। এরমধ্যে পর্যটনকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে করা হয়েছিলো।
''কিন্তু এই খাতের ব্যবসায়ীরা এখন করোনার কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দ্রুত তাদের ব্যবসা সচল হওয়ারও কোনো আশা নেই'', যোগ করেন তিনি।
সিলেটের হোটেল-রিসোর্ট মালিকরা বলছেন, প্রতিদিন কেবল সিলেটের হোটেল-রিসোর্ট খাতে প্রায় তিন কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। মাসে ক্ষতি প্রায় একশ' কোটি টাকা।
সিলেটের খাদিম ও লালাখালে বড় বিনিয়োগের দুটি রিসোর্ট রয়েছে নাজিমগড় গ্রুপের। এগুলোতে কাজ করতেন প্রায় সাড়ে ৩শ' কর্মী। এদের মধ্যে হাতেগোনা ছাড়া সবাইকেই অবৈতনিক ছুটি দেওয়া হয়েছে।
রিসোর্ট দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজিম কামরান চৌধুরী বলেন, ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ। ফলে কর্মীদের ছুটি দিতে হয়েছে। সকলের বেতন দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
আরেক সমস্যার কথাও শোনালেন নাজিম কামরান। তিনি বলেন, প্রথমে বিদ্যুৎ বিলে জরিমানা মওকুফের কথা বলা হয়েছিল। ফলে আমরা গত তিন মাসে বিল দেইনি। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, এই ঘোষণা শুধু গৃহস্থালির গ্রাহকদের জন্য। বাণিজ্যিক ও শিল্পের গ্রাহকদের জন্য নয়। ফলে জরিমানা দিতে হচ্ছে।
''এ ছাড়া ভুতুড়ে বিলও আসছে। রিসোর্ট চালু অবস্থায় যে পরিমাণ বিল আসতো এখন পুরো বন্ধ অবস্থায়ও একই পরিমাণ বিল আসছে। যা অনেকটা মরার উপর খড়ার ঘা'', বললেন তিনি।
একই ধরনের সমস্যার কথা বললেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এসকেডি 'আমার বাড়ি রিসোর্ট' এর পরিচালক সজল দাশও। তিনি বলেন, আমার ব্যাংক লোন আছে দুই কোটি টাকা। মার্চের ১১ তারিখ থেকে রিসোর্ট বন্ধ। কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিলের জন্য চাপ আসছে। সব কিছু মিলিয়ে আমরা ঋণের জালে আটকে যাচ্ছি। পুঁজি হারানোর ভয়ে আছি।
একই এলাকার হোটেল মেরিনার পরিচালক নাজমুল হাসান মিরাজ বলেন, আমার হোটেলটি ভাড়া নিয়ে করেছি। মাসিক ভাড়া এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতনসহ মাসিক খরচ আড়াই লাখ টাকা। বর্তমানে ঋণে জড়িয়ে পড়েছি। সরকারের সাহায্য ছাড়া এই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারব না।
সিলেট হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, এই সংগঠনের সদস্যভূক্ত হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে ৩৪টি। তবে সিলেটে ছোট-বড় মিলিয়ে হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে দুই শতাধিক। সিলেট বিভাগে এই সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের সবগুওেলা হোটেল-রিসোর্ট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর করোনা পরিস্থিতির উন্নতির বদলে দিনদিন তো অবনতিই হচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫৭৫৪ জনের।
শ্রীমঙ্গল শহরের গ্রিনলিফ রিসোর্টের পরিচালক এস কে দাস সুমন বলেন, গত বছর ঈদের এক মাস আগেই আমার রিসোর্টের সব কক্ষ বুকড হয়ে যায়। এখানে বেশিরভাগ বিদেশি অতিথিরা আসেন। কিন্তু এবার ঈদে পুরো ফাঁকা ছিলো রিসোর্ট। আগামী ঈদেও রিসোর্ট বন্ধ থাকবে।
সিলেটের পর্যটন খাতের উন্নয়নে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন হাসান মোরশেদ। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে আমরা জানি না। তবে স্বাভাবিক হলেও পর্যটন সেক্টরের সংকট কেটে যাবে না। কারণ মানুষের আয় কমবে। ফলে খরচ কমাবে। আগের মতো পর্যটকরা আসবেন না। এতে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে পর্যটন খাতের উদ্যোক্তাদের। ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই হয়তো টিকতে পারবেন না।
সিলেট নগরীর দরগাহ গেইট এলাকার হোটেল নুরজাহানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. নাসিম আহমদ বলেন, প্রণোদনার নামে ঋণ দিয়ে এই খাতকে চাঙ্গা করা যাবে না। বরং এককালীন ভর্তুকি প্রয়োজন। সরকারের বিশেষ সহযোগিতা ছাড়া হোটেলখাতের আবার ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।