হদিস নেই পাচারের শিকার ২৬০০ নারী-শিশুর
- ১৭ বছরে পাচারের শিকার ১২৩২৪ জন পুরুষ, নারী ও শিশু
- পাচারের শিকার ৯৭১০ জনকে উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন এনজিও
- ৬৭৩৫ মামলায় গ্রেফতার হয়েছে পাচার চক্রের ১২২৮০ সদস্য
- মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ২৩৩টি, এসব মামলায় শাস্তি হয়েছে ৪০৯ জনের
- মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন ১৭১৬ জন, মীমাংসা হয়েছে ৮১০ মামলা
- পাচারের মাত্র ৬টি মামলায় মৃত্যুদণ্ড সাজা হয়েছে
নাইমা আক্তার, পেশায় একজন পোষাক শ্রমিক। কাজ করতেন ঢাকা জেলার আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার একটি পোষাক কারখানায়। ফরিদপুরের মেয়ে নাইমাকে ভালো বেতনের চাকরির কথা বলে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে পাচার করে একটি চক্র। পাচারের চার বছর পরেও এই নারীকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
শুধু নাইমা আক্তার নয়, গত ১৭ বছরে বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার হয়েছেন ১২৩২৪ পুরুষ-নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ৯৭১০ জনকে বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার করলেও এখনও হদিস মিলেনি পাচারের শিকার ২৬১৪ জন নারী ও শিশুর।
এ প্রসঙ্গে মানব পাচার সংক্রান্ত একাধিক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মেহেদী হাসান টিবিএসকে বলেন, ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে নারী,পুরুষ, শিশুদের পাচার করছে একাধিক চক্র। পাচারের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
পাচারের শিকার নারী-পুরুষ ও শিশুদের কেন উদ্ধার করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মানব পাচার বন্ধের পাশাপাশি পাচারের শিকার নারী ও শিশুদের উদ্ধারেও আমরা কাজ করি। অনেককেই উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে অনেক ভুক্তভোগী আছেন, যাদের অবস্থা শনাক্তের পরও সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগিতার অভাবে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না'।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেব বলছে, গত ১৭ বছরে পাচার সংক্রান্ত ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৭৩৫টি। আর এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ২৭৩৬৩ জনকে। এদের মধ্যে ১২২৮০ জনকে গ্রেফতার করেছে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ১৭ বছরে তদন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ২৩৩টি মামলার। আর এসব মামলায় শাস্তি হয়েছে ৪০৯ জনের। এছাড়াও ৮১০টি মামলা মীমাংসা হয়েছে। তদন্ত শেষে মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন ১৭১৬ জন। আর ছয়টি মামলায় মোট আটজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছে ২৯৯ জনের। বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ও জরিমানা হয়েছে আরও ১০২ জনের।
মানব পাচার রোধে পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা কাজ করলেও নারী ও শিশু পাচারের অবস্থার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। প্রায় প্রতিদিনই পাচার করা হচ্ছে নারী ও শিশুদের। পাচারের শিকার অধিকাংশ নারীই বিদেশে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তারা বলেন, ভালো চাকুরির প্রলোভন থেকে শুরু করে হালের টিকটক ভিডিওর কথা বলে নারীদের বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
নারীদের বেশি পাচার করা হচ্ছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও সৌদি আরব, দুবাই, চীনসহ বিভিন্ন দেশে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় অনেকে কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যেতে চেয়ে মানব পাচারের শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও নারী ও শিশুদের ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন দেশে পাচার করছে একাধিক চক্র।
গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই পাচার চক্রের ফাঁদ
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম আক্তারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, গ্রাম থেকে শহর সব জায়গায় রয়েছে মানব পাচারকারী চক্রের বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক। নতুন নতুন রুট আবিস্কার করে বিভিন্ন দেশে নারী–পুরুষদের পাচার করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
মানব পাচার মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, গ্রামের বেকার যুবক ও সহজ সরল নারীদের টার্গেট করে চক্রের সদস্যরা। পরে ভালো বেতনের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে ধাপে ধাপে তিন থেকে আট লাখ হাতিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, বিদেশে গিয়ে পাচারের শিকার অধিকাংশরাই পড়েন মহাসংকটে। কোন চাকরি না পেয়ে এদের একটা বড় অংশ সেই দেশের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে আটকে যান।
আবার অনেকেই বিদেশ গিয়েও চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হোন। বিদেশে টর্চার সেলে আটকে নির্যাতনের ভিডিও করে দেশে থাকা পরিবারের সদস্য থেকে আবারও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন তারা।
মানব পাচার চক্রের সদস্যরা শুধু গ্রামে নয়, শহরেও রয়েছেন সক্রিয়। পিবিআইয়ের পরিদর্শক মেহেদী হাসান বলেন, 'মানব পাচারের ঘটনায় কেরানীগঞ্জের একটি মামলার তদন্তে ফিরোজ নামের এক চক্রের হোতার সন্ধান পেয়েছি। তিনি কম্বোডিয়ায় বসে ঢাকার অনেক ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে'।
'মামলা তদন্তে আমি পেয়েছি এই চক্রটি এক পরিবারের ৫ জনকে কানাডায় পাঠানোর কথা বলে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই চক্রের সদস্য রাহুল, সুদীপসহ বেশ কয়েকজন ভারতে বসে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে'।
মানবপাচার নিয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার টিবিএসকে বলেন, 'মানবপাচার বন্ধ করতে হলে গুরুত্ব দিয়ে পাচারকারী চক্রের সদস্যদের অর্জিত সম্পদের তদন্ত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দিয়ে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ যদি তাদের ভোগ করতে না দেয়া হয় তাহলে মানব পাচার অনেকাংশে কমে আসবে'।
মানব পাচার নিয়ে কাজ করা যশোর রাইটের তথ্য অনুসন্ধান কর্মকর্তা তৌফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'পুলিশের কাছে শুধুমাত্র থানায় মামলা হওয়া ঘটনাগুলোর তথ্য রয়েছে। থানার বাইরে আদালতেও মানব পাচারের অনেক মামলা হয়। এছাড়া মানব পাচার নিয়ে তিনটি এনজি কাজ করে। তাদের কাছেও অনেক অভিযোগ আসে। তাই প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে'।
তিনি বলেন, 'পাচারের শিকার নারী-শিশুর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঠিটি দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি অনুসন্ধান করে একটি ক্লিয়ারেন্স দেন। পরে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়'।
পাচারের শিকার প্রায় ২০০ জনকে ফিরিয়ে আনার যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তবে করোনার কারণে তাদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।