হাওরে বাঁধের কাজে ধীরগতি, অনিয়মের অভিযোগ
২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সবগুলো বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। অথচ ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুনামগঞ্জের অনেক হাওরেই বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আর এতে ফসল নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে হাওরের কৃষকদের মধ্যে।
এদিকে, অনেক প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া এবং অক্ষত বাঁধ সংস্কারের নামে বড় প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তার দাবি, যেসব বাঁধে কাজ করার প্রয়োজন, সেসব বাঁধেই কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্প তৈরি বা প্রাক্কলনে কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রায় সব বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে।
পাহাড়ি ঢল আর অকাল বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে হাওরগুলোর চারপাশে নির্মাণ করা হয় উঁচু বাঁধ। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে পানিতে এসব বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের বছর শুষ্ক মৌসুমে আবার তা সংস্কার করতে হয়। তবে প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। ফলে বৈশাখের দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই ঢল নেমে আগাম বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান।
সাম্প্রতিককালে, ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় হাওরে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় হাওর থাকলেও সুনামগঞ্জেই এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। হাওরের রাজধানী হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে প্রায় ১৬০টি হাওর রয়েছে। ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় সরকারি হিসেবে, ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে, এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
সে বছর ফসলহানির পর পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি নিয়ে দুদক ও আইনজীবী সমিতির করা দুটি মামলা এখনো চলছে।
২০১৭ সালের ব্যাপক ফসলহানির পর হাওরের বাঁধে অনিয়মের বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসে। এরপর বাঁধ নির্মাণ নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে এখনো বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
হাওরপাড়ের কৃষকদের দাবি-দাওয়া রক্ষায় গঠিত কৃষক সংগঠন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরি সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, 'গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার আমি সরেজমিনে শাল্লা উপজেলার ৩০-৩৫টি বাঁধ পরিদর্শন করেছি। এখানে অনেক বাঁধের কাজই শুরু হয়নি। যে কয়টি বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে সেখানে কোনো নীতিমালা মানা হচ্ছে না। কাজ শুরুর সাথে সাথে দর্শনীয় স্থানে প্রকল্পের সাইনবোর্ড টানানোর কথা থাকলেও সাইনবোর্ড ছাড়াই কাজ করা হচ্ছে। মাত্র ৭টি স্থানে সাইন বোর্ড পাওয়া গেছে। শাল্লার অধিকাংশ প্রকল্পে অতিরিক্তি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।'
জানা যায়, পাউবো'র আওতাধীন সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় ৫২টি হাওরের দুই লাখ ২৩ হাজার ৩০০ হেক্টর বোরো জমির ফসল রক্ষায় ৬১২ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার ও মেরামতে চলতি বছর ১২৬ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ৭৮৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) বাঁধের কাজ করবে, যার অনুকূলে প্রাথমিকভাবে ৬২ কোটি টাকা অনুমোদন হয়েছে।
পাউবো'র কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা অনুযায়ী জমির মালিক ও প্রকৃত কৃষকদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করে বাঁধের কাজ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বরের পর হাওরে বোরো ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ শুরুর কথা থাকলেও প্রায় দুই মাস পেরোতে চললেও কোনো কোনো বাঁধের কাজ শুরু হয়নি। বোরো চাষাবাদ শেষ পর্যায়ে হলেও অনেক হাওরে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ এখনো শুরু হয়নি। ফলে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়া ও আগাম বন্যায় ফসলহানির শঙ্কায় রয়েছেন চাষিরা।
জেলার সদর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও শাল্লার উপজেলার অনেক প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণ কাজ এখনো শুরু হয়নি। এসব উপজেলার দেখার হাওর, খরচা, জোয়ালভাঙ্গা, ডাউকা, কাংলার হাওরে বাঁধের কাজ সবচেয়ে কম হয়েছে।
জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৩২টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের জোয়ালভাঙ্গা হাওরে ৭নং পিআইসি'র ১ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার কাজে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই কাজে এখনো মাটি ফেলা হয়নি। এর পাশের প্রকল্প ৮নং পিআইসিতে সমপরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হলেও অর্ধেকের বেশি জায়গায় এখনো কোনো মাটিই পড়েনি।
রঙ্গারচর ইউনিয়নের কাংলার হাওরের ৩নং প্রকল্পের অক্ষত বাঁধে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক। ১নং প্রকল্পে অক্ষত বাঁধ সংস্কার কাজে ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২নং পিআইসিতে গত ৩ বছর ধরে কাজ করছেন একই ইউপি সদস্য। ইউপি সদস্য সুরুজ আলীর বিরুদ্ধে বিগত সময়ে বাঁধ নির্মাণে নানা অভিযোগ থাকলেও এবারও গুরুত্বপূর্ণ বড়ভাঙ্গা ক্লোজারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে।
জামালগঞ্জের উপজেলার মিনি পাগনা হাওরের ৩টি পিআইসিতে গত মৌসুমের চেয়েও এই মৌসুমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আবার কোনো পিআইসিতে কাজের তুলনায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কম।
জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের সবচেয়ে কাছের ৪নং পিআইসির ডুবন্ত বাঁধের ভাঙন বন্ধকরণ ও মেরামত কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের বরাদ্দ হচ্ছে ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। হালির হাওরের ২৫নং পিআইসির উপ-প্রকল্প ডুবন্ত বাঁধের ভাঙন বন্ধকরণ ও মেরামত কাজ শুরুই হয়নি। ৩২নং প্রকল্পের বাঁধের কাজ শুরু হয়নি এখনো।
ফেনারবাঁক ইউনিয়নের পাগনার হাওরপাড়ের গজারিয়া গ্রামের কৃষক মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, 'গত বছর এখানকার বাঁধগুলোতে বরাদ্দ ছিল কম, কাজ ছিল বেশি। এ বছর বরাদ্দ বেশি, কাজ কম। এখানকার তিন বাঁধে এত বেশি বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এখানে বড় কোনো ভাঙনও নাই।'
ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল, কাইল্যানী, সোনামড়ল, গুরমা, গুরমার বর্ধিতাংশ, গোড়াডুবা, জয়ধনা ও ধানকুনিয়া হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজের জন্য ১৬৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। অনেক প্রকল্প এলাকায় কোনো সাইনবোর্ড নেই। ফলে কে কোন প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ পেয়ে কাজ করছে, তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারছেন না কেউ।
হাওরে বোরো ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জেলার হাওরের উপজেলা শাল্লায়। এই উপজেলার ছায়ার হাওরের কয়েকটি বাঁধের বেশির ভাগ অংশই অক্ষত থাকার পর বাঁধ নড়বড়ে দেখিয়ে অধিক বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শাল্লায় প্রায় ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে।
শাল্লার আঙ্গাউড়া গ্রামের কৃষক শনি দাস বলেন, 'আমাদের এলাকার দুটি প্রকল্পেই বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে এক থেকে দুই লাখ টাকা দিলেই কাজ করা সম্ভব হতো, সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। সরকারি টাকা নয়-ছয় করতেই অতিরিক্ত বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।'
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, 'বাঁধের নামে হরিলুট চলছে। প্রতিটি বাঁধে দুর্নীতি ও প্রভাবশালী লোকের হস্তক্ষেপ রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধের কাজ শুরু হয়নি। পানি ও আগাম বন্যার আগে বাঁধের কাজ শেষ হবে বলে বিশ্বাস হয় না। গণশুনানির মাধ্যমে প্রকৃত জমির মালিক ও কৃষকদের দিয়ে পিআইসি গঠন করা হয়নি। বাঁধের কাজে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে করে হাওরের পানি সময়মত নিষ্কাশন না হওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।'
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাবিবুর রহমান বলেন, 'বন্যার পানি হাওর থেকে নামতে দেরি হওয়ায় পিআইসি গঠন ও বাঁধের কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে আশা করছি ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব। যেসব স্থানে কাজ করার প্রয়োজন, সেখানেই বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। অনেক এলাকায় প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে প্রভাবশালীদের দিয়ে পিআইসি গঠন করার অভিযোগ পেয়েছি। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'