হাসিনা-মোদি বৈঠকের কেন্দ্রবিন্দু দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ
উদীয়মান অর্থনীতির ৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস জোটের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) বাংলাদেশকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
গতকাল অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সম্মেলনে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ বিস্তারের লক্ষ্যে ভারত-মায়ানমার-থাইনল্যান্ডের ত্রিদেশীয় আন্তর্জাতিক সড়ক নির্মান প্রকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ব্যাপারে ভারতের সমর্থন চেয়েছেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়।
৫৫ বছর ধরে বন্ধ থাকা চিলাহাটি- হলদিবাড়ি রেল সংযোগ উদ্বোধনের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও এগিয়ে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন দুটি দেশের প্রধানমন্ত্রী।
তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিসহ অন্যান্য ৬টি নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারটি বৈঠকে উঠে এলেও এবিষয়ে পরবর্তী যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার ব্যাপারে সম্মত হয় উভয় পক্ষ।
এছাড়াও মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে ভারত। ভার্চুয়াল সম্মেলনে বাণিজ্য, কৃষি ও জ্বালানি সহ ৭ খাতে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে উভয় প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের কর্মকর্তাদের সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশিদারিত্ব চুক্তির (সিইপিএ) চলমান যৌথ গবেষণা দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।
সম্মেলন শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সম্মেলনের ব্যাপারে যৌথ বিবৃতি দেন। বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী অগ্রাধিকার নীতির শীর্ষে আছে জানিয়ে ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময় বাংলাদেশকে প্রাধান্য দেয় বলে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
ব্রিকস ব্যাংকে যোগদানের আমন্ত্রণ
উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস জোট। এসব দেশে পরিকাঠামো ও টেকসই উন্নয়নেই কাজ করে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)। এনডিবিতে বাংলাদেশকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এব্যাপারে জানিয়েছেন, " আমরা ব্যাংকটির সদস্য হতে পারলে নতুন অর্থায়ন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে এটি নির্ভর করছে তারা কিধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবেন তার ওপর।"
৭টি চুক্তি সই
এ সম্মেলনের আগেই ৯টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সইয়ের আভাস দিয়েছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ৭টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলো হলো হাইড্রোকার্বন খাতে সহযোগিতা বিষয়ক রূপরেখা, কৃষিখাতে সহযোগিতা, নয়াদিল্লি জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সহযোগিতা, হাতির সুরক্ষায় অভয়ারণ্য নিশ্চিত করা, হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প চালু, বাংলাদেশ-ভারত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফোরামের টার্ম অব রেফারেন্স এবং বরিশালে সুয়ারেজ প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যন্ত্রপাতি সরবরাহে সমঝোতা স্মারক।
তিস্তা ও সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গ
বৈঠকে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টন ও সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে।
২০১১ সালে উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে তিস্তার পানি বন্টনের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে 'ভারতের আন্তরিকতা' এবং মোদি সরকারের 'অব্যাহত প্রচেষ্টা' আছে বলে জানান নরেন্দ্র মোদি।
সীমান্ত হত্যা ও ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী জানিয়েছেন আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনে উভয় নেতাই সমন্বিত ও যৌথ টহলের উপর গুরূত্বারোপ করেছেন।
বিএসএফ সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র শুধু আত্মরক্ষার্থে শেষ সম্বল হিসেবে ব্যবহার করবে এমন আশ্বাস দিয়েছে ভারত।
পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, "বাংলাদেশি হিসেবে এব্যাপারটি আমাদেরও হতাশ করে। তবে ব্যাপারটি সমাধানের দিকে এগুচ্ছে এবং আমরা আশাবাদী।"
সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সংযোগ
১৯৬৫ সাল পূর্ববর্তী রেল সংযোগ স্থাপনের অব্যাহত অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন উভয় পক্ষ।
কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলায় ভারতীয় পণ্যের পরীক্ষামূলক পরিবহন ও সোনামুড়া - দাউদকান্দি প্রোটোকল রুট চালুর ব্যাপারেও আলোচনা হয়।
এছাড়াও ভারত-মায়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এই প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে ভারতের সমর্থন চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ (হিলি) থেকে মেঘালয় (মহেন্দ্রগঞ্জ) পর্যন্ত যোগাযোগের অনুমতি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছ ভারত।
ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আলোচনাও হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে মানবিক সহায়তার জন্য বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেন নরেন্দ্র মোদি। সেইসাথে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, দ্রুত ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় ভারতকে অভিনন্দন জানিয়ে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ভারতের সমর্থন চেয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন শেখ হাসিনা।
রপ্তানি বৃদ্ধি
ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি ও সামগ্রিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশিদারিত্ব চুক্তির (সিইপিএ) ওপর যৌথ গবেষণা শুরু হয়েছে।
এ চুক্তি হলে উভয় দেশ অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে, ভারতের বিনিয়োগ এ দেশে আনা এবং পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রেলসংযোগ অধিক কার্যকর, তুলনামূলক পরিবেশবান্ধব ও মহামারির সময়ে নির্ভরযোগ্য এব্যাপারে সম্মত হয়েছে উভয়পক্ষ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ সহ কোনো পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আলোচনায় এ বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যাতে বিকল্প পন্থা বেছে নিতে পারে সেকারণে স্বচ্ছ ও অনুমানযোগ্য নীতি নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা
ভারতে ভ্যাকসিন সহজলভ্য হিলে বাংলাদেশও ভ্যাকসিন পাবে বলে আশ্বস্ত করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী জানিয়েছেন বিগত মাসগুলোতে কোভিড-১৯ মোকেবেলার যাবতীয় তথ্য বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসকে সরবরাহ করেছে ভারত।
"ভ্যাকসিনের ব্যবহার ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করছি আমরা। ভারতের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনে আগ্রহী হলে আমরা সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি।" বলেন তিনি।
দুই নেতার বক্তব্য
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উদ্বোধনী বক্তব্যে উভয় দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভ্যালু চেইন আরও সম্মৃদ্ধ করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন ভারতের প্রতিবেশী অগ্রাধিকার নীতির অন্যতম খুঁটি বাংলাদেশ। তিনি আরও জানিয়েছেন, তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশের শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।