‘অচেনা প্রাণী’র কামড়ে আতঙ্ক, পরামর্শ মানার তাগিদ বন বিভাগের
'অচেনা প্রাণী'র আক্রমণে আতঙ্কিত হয়ে আছেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের লোকজন। এখন আর কেউ লাঠি ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না। এমনটি ছোট ছেলে-মেয়েদের অন্য এলাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
তবে বন বিভাগ বলছে, পরামর্শ মেনে সাবধান থাকলে আক্রমণ এড়ানো সম্ভব।
স্থানীয়রা জানান, পলাশবাড়ীতে গত ১ মাসে অন্তত ১১ জনকে হামলা করেছে ওই অচেনা প্রাণী। আক্রান্তদের মধ্যে কয়েকজন নারী ও শিশুও রয়েছে।
পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের হরিণাথপুর, তালুক কেঁওড়াবাড়ি, কিশামত কেঁওড়াবাড়ি, খামার বালুয়া ও ফতের ভিটা- এ পাঁচ গ্রামে ঘটেছে এ ঘটনা। আক্রান্ত ব্যক্তিরা এরই মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন।
হরিণাথপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, '১৫ দিন আগে আমার এক প্রতিবেশী মারা গেছেন। এরপর প্রশাসনের লোকজন আমাদের নিরাপত্তার খোঁজ-খবর নিচ্ছে।'
সাইফুলের স্ত্রী ফরিদা পারভীন জানান, গত এক মাসে স্থানীয় এক নারী, শিশু ও যুবককে কামড় দিয়েছে ওই প্রাণী। তারা হলেন রাব্বী (১২), আমিরুল ইসলাম (২৮) ও শেফালী বেড়ম (৫০)। তারা ইতোমধ্যে বগুড়ার সদর হাসপাতাল থেকে জলাতঙ্কের টিকা নিয়েছেন। এর পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসাও নিছেন। তারা বর্তমানে সুস্থ।
এর মধ্যে রাব্বীকে গত রোববার অচেনা ওই প্রাণী কামড় দেয়। তার বাবার নাম ময়নুল শেখ বলেন, 'বাড়ির পাশের রাস্তায় ধান ক্ষেতের পাশে রাব্বী খেলাধুলা করছিল। এ সময় অচেনা ওই প্রাণী রাব্বীকে আক্রমণ করে। এতে তার চোখের বাম পাশে ক্ষত হয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে গাইবান্ধা সদর হাতপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে জলাতঙ্গের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের মনে এখনো আতঙ্ক রয়ে গেছে।'
সম্প্রতি উত্তর কেওড়াবাড়ি গ্রামের মসজিদের ইমামের ফেরদাউস সরকার রুকুর অচেনা প্রাণীর আক্রমণের পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মা ফজিলেতুন নেছা (৬৫) জানান, তার ছেলে মাঠে ঘাস কাটতে গিয়েছিল। হঠাৎ এটি প্রাণী এসে তাকে সামনে থেকে আক্রমণ করে। ওই আক্রমণে তার নাক, ঠোঁটের মাংস ছিঁড়ে যায়। এরপর তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এর দুই সপ্তাহ পর আবার জ্বর ও মাথাব্যথা শুরু হলে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নেওয়া তাকে। এ সময় তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়।
মূলত ফেরদাউসের মৃত্যুর পর থেকেই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন বাইরে বের হতে ভয় পায়। তখন থেকেই আক্রমণ করা ওই প্রাণী সম্পর্কে লোকজন নিজের মতো বর্ণনা দেওয়া শুরু করে। স্থানীয়রা ওই প্রাণীকে হায়েনা, নেকড়ে, শুয়োর, শেয়ালের মতো দেখতে কোনো প্রাণী বলে মনে করছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকায় মানুষের মধ্যে যে অচেনা প্রাণী নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, সেটি সম্ভব শেয়াল। কারণ গত দেড় মাসের ব্যবধানে স্থানীয়রা তিনটি শেয়াল হত্যা করেছে। ওই শেয়ালগুলো লোকালয়ে এসে মানুষজনের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করেছিল।
ফরিদা পারভীন বলেন, 'শেয়ালের মতো দেখতে ওই প্রাণীর জন্য মানুষ এখন বাইরে চলাচলের সময় লাঠি হাতে নিয়ে যাচ্ছে। জমিতে ধান দেখতে গেলেও মানুষ লাঠি হাতে নিয়ে যাচ্ছে। দিনে-রাতে সমস্যা সমান। ভয়ে আমার দুই সন্তানকে পাশের ইউনিয়ন মনোহরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এলাকার কেউ আর বাইরে একা বের হচ্ছে না।'
গত ২৫ সেপ্টেম্বর আমিরুল চৌধুরী নামে একজনকে কামড় দিয়েছে ওই প্রাণী। তিনি জানান, সকালে ধান ক্ষেতের আইলে তিনি ঘাস কাটছিলেন। এ সময় পেছন দিক থেকে একটি প্রাণী তার উরুতে কামড় বসায়। হঠাৎ কামড়ে চমকে উঠে তিনি ওই প্রাণীকে পাল্টা আক্রমণ করেন। এ সময় প্রাণীটি ধান ক্ষেতের ভেতর চলে যায়। 'এটি শেয়ালের মতোই দেখতে। অন্য প্রাণী হওয়ার কথা নয়,' বলেন আমিরুল।
তিনি আরও বলেন, 'ওই প্রাণীর কামড় খেয়ে সেদিন দুপুরে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে গিয়ে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন নিয়েছি। আমি এখন সুস্থ। তবে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক এখনো কাটেনি। হঠাৎ এই প্রাণীর আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এখন লাঠি ছাড়া কেউ কোথাও বের হয় না। বাজারে গেলেও হাতে লাঠি নিয়ে বের হতে হচ্ছে।'
জেলা প্রাণী সম্পাদক কর্মকর্তা ডা. মো. মাছুদার রহমান সরকার বলেন, 'প্রাথমিকভাবে ওই প্রাণীকে আমাদের কাছে শেয়াল বলে মনে হয়েছে। কারণ খাদ্যের অভাব হলে শেয়াল লোকলয়ে গিয়ে আক্রমণ করে। আর শেয়াল জলাতঙ্কের ভাইরাস বহন করে। এই সময় শেয়াল সামনে যাকে পাবে, তাকেই কামড় দেবে। অনেক সময় বাড়ির উঠানে গিয়েও কামড়াতে পারে। শেয়ালের কামড় খেলে ভ্যাকসিন নিতেই হবে। তবে আজ (রোববার) রাজশাহী থেকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তারা সঠিকভাবে বলতে পারবেন, ওই প্রাণী আসলে কী?'
পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, 'ওই প্রাণী চিহ্নিত করার জন্য স্পটে বন বিভাগের কর্মকর্তারা রয়েছেন। তবে এখনো প্রাণীটির দেখা মেলেনি। অবশ্য স্থানীয়দের বরাতে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাণীটি শিয়ালই হবে।'
রাজশাহী বন বিভাগের পাঁচ সদস্যের একটি দল পলাশবাড়ীর ঘটনাস্থলে রয়েছেন। এই দলের প্রধান বন্যপ্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেন, 'এখনো আমরা আক্রমণাত্মক কোনো প্রাণী দেখতে পাইনি। এ কারণে নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না, আসলে প্রাণীটি কী? তবে আক্রমণ থেকে সুরক্ষা থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। সাধারণত আগুন জ্বালিয়ে রাখলে কোনো প্রাণী আক্রমণ করার সাহস পায় না। এছাড়া রয়েছে- উচ্চ শব্দ করা, ঘরবাড়ি সুরক্ষিত করা। এর পাশাপাশি এলাকার লোকজনকে জলাতঙ্কের অগ্রিম ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'লোকজন আতঙ্কিত হয়ে যেন কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা না করে, এ কারণে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এলাকার মানুষকে সতেচন করা হচ্ছে। তবে এই সংক্রান্ত যে সংবাদগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার অধিকাংশই গুজব।'