৫০০ শতাংশের বেশি গৃহকর বাড়িয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
চট্টগ্রাম নগরের মধ্যম মানের আবাসিক এলাকা নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি। সাড়ে তিনকাঠা জমির উপর পাঁচতলা বাড়ির জন্য ব্যবসায়ী মিনহাজুর রহমানকে বার্ষিক ২০ হাজার ৭২৫ টাকা গৃহকর পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন কর কাঠামোয় তাকে ওই বাড়ির জন্য চলতি বছর কর দিতে হবে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা; যা আগের চাইতে ৮২০ শতাংশ বেশি!
এভাবেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের চলতি অর্থবছর থেকে পূর্বের তুলনায় সর্বোচ্চ ১ হাজার শতাংশ থেকে সর্বনিম্ন ৫৪৫ দশমিক ৩২ শতাংশ পর্যন্ত গৃহকর দিতে হচ্ছে, যদিও অনেক আগ থেকেই চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দারা রাজধানী ঢাকার তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি গৃহকর পরিশোধ করে আসছিলেন।
জুলাই মাসের শুরু থেকে 'বর্ধিত' গৃহকর আদায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এ লক্ষ্যে চসিকের ৮টি রাজস্ব সার্কেল থেকে হোল্ডিং মালিকদের ধার্য করা গৃহকরের নোটিশ পাঠানো হচ্ছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দারা। তারা আশঙ্কা করছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাঝে বাড়তি গৃহকর সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবে। চাপে থাকবেন ভবনমালিক ও ভাড়াটিয়া সবাই।
নগরীর হালিশহর সবুজবাগ আবাসিক এলাকার ভবন মালিক খালেদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে ভবনের মূল্যায়ন করা হতো বর্গফুটের ভিত্তিতে। কিন্তু নতুন নিয়মে তা ভবনের ভাড়া বা আয়ের বিপরীতে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ভাড়াটিয়াদের ভাড়া বৃদ্ধি করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।'
বিষয়টি স্বীকার করে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, 'নতুন নিয়মে কর পরিশোধ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে যদি তারা আপিল করেন, তাহলে যতটুকু পারা যায় সহনীয় করা হবে।'
২০১৬ সালের মার্চে 'পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়ন কর্মসূচি'র মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে প্রণীত 'দ্য সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস' অনুসারে বাড়ি ভাড়ার ভিত্তিতে হোল্ডিংয়ের কর নির্ধারণের কাজ শুরু করেছিলেন তখনকার মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এসময় স্থাপনার আয়তন হিসেবে (আগের নিয়মে) হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে চসিকের ওই উদ্যোগ আটকে যায়। পাশাপাশি কর পুনর্মূল্যায়ন স্থগিত রাখতে এবং আগের হারে গৃহকর আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু রেজাউল করিম চৌধুরী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পঞ্চবার্ষিক কর পুনঃমূল্যায়নের ভিত্তিতে গৃহকর আদায়ের ওপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে দুই দফা চিঠি দেয় চসিক। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে গত ১৮ জানুয়ারি নিজেদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। গৃহকরের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হওয়ায় চলতি বছর থেকে ভাড়ার ভিত্তিতে কর আদায় শুরু করেছে চসিকের রাজস্ব বিভাগ। ফলে আগের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি পৌরকর দিতে হবে নগরবাসীকে।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গৃহকর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। কিন্তু হিসাব বলছে, চলতি বছর নতুন নিয়মে কর আদায় হলে এই খাতে রাজস্ব বেড়ে দাঁড়াবে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, '১৯৮৬ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের মেয়াদে এক ভুল অধ্যাদেশে গৃহকরের এ ধারণার জন্ম হয়েছিল, যা বিশ্বের আর কোথাও চালু নেই। বাড়িভাড়া হলো বাড়ির মালিকের আয়, যার ভিত্তিতে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নিয়মমাফিক প্রতি বছর আয়কর পরিশোধ করতে বাধ্য। ঐ একই বাড়িভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে যদি তাঁকে আবার গৃহকর দিতে হয় তাহলে তো আয়ের ওপর 'ডাবল ট্যাঙেশন' হয়ে যাবে, যা সর্বস্বীকৃত করনীতির পরিপন্থী।'
এ-ব্যাপারে কিছু করতে হলে প্রথমে সকল সিটি করপোরেশনের গৃহকরের সামঞ্জস্য বিধানকল্পে নতুন আইন প্রণয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অর্থনীতিবীদ।
চসিকের সাবেক মেয়র ও জাতীয় পার্টির নেতা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'আমাদের শাসনামলেই অধ্যাদেশটি জারি হয়েছিল, কিন্তু আমি কার্যকর করিনি। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাসহ কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কাজ শুরু করেছে। এসব সিটি করপোরেশনের কাজ না। বাড়তি এ কার্যক্রম পরিচালনা করায় খরচ বেড়ে গেছে।'
ঢাকার চেয়ে বেশি গৃহকর দিয়েও সেবা নেই চট্টগ্রামে
সিটি করপোরেশন অ্যাক্ট- ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে চসিক সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যে ১৭ শতাংশ কর আদায় করা হয় তার মধ্যে, ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স, ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন এবং ৭ শতাংশ আবর্জনা অপসারণের জন্য আদায় করা হয়।
বিপরীতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন আদায় করে ১২ শতাংশ পৌরকর। এর মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স ৭ শতাংশ, আলোকায়ন রেইট ৩ শতাংশ এবং বর্জ্য অপসারণ রেইট ২ শতাংশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও ১২ শতাংশ পৌরকর আদায় করে। এর মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স ৭ শতাংশ, আলোকায়নে ২ শতাংশ, বর্জ্য অপসারনে ২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যকর নেওয়া হয় ১ শতাংশ।
কিন্তু বাড়তি কর দিয়েও প্রয়োজনীয় সেবার কোনো কিছুই পাচ্ছেন না চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দারা। আবর্জনা অপসারনের জন্য ৭ শতাংশ কর দেওয়ার পরেও দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত এ শহরে এখনো যত্রতত্র দেখা মেলে বর্জ্যের।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মোনোয়ার আহমেদ বলেন, 'আবাসিকের বাসা-বাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও চসিকের কর্মীরা প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে মাসিক ৫০ থেকে ৭০ টাকা চুক্তিতে বর্জ্য নিয়ে যান। টাকা না দিলে বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয় না।'
এছাড়া আলোকায়নের জন্য ৩ শতাংশ কর নেওয়া হলেও প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়া বাকি প্রায় সব আবাসিক এলাকায় সড়কবাতির অধিকাংশ বেশিরভাগ সময় নষ্ট থাকে। এছাড়া গত তিন দশকে নগরের সড়কগুলোতে সিগন্যাল লাইটের জন্য চসিক ১০ কোটি টাকার বেশি খরচ করলেও এই ডিজিটাল যুগেও চট্টগ্রামে যানবাহন চলে হাতের ইশারায়।
চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ও মুখপাত্র হাসান মারুফ রুমী বলেন, 'ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামবাসী নাগরিক সুবিধা কম ভোগ করেন। তারপরও কর বেশি আদায় করাটা অযৌক্তিক। স্থগিত থাকা গৃহকর আদায় কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি নিয়ে আমরা শীঘ্রই মাঠে নামব।'
এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'আইনগত কারণে প্রস্তাবিত গৃহকর আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করতে হলো। এজন্য বিল দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে কারো আপত্তি থাকলে আপিল করতে পারবেন।'