যুক্তরাজ্যে নতুন আইনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ার শঙ্কায় আশ্রয়প্রত্যাশী, অবৈধ অভিবাসীরা
যুক্তরাজ্যের আশ্রয়ণ ও অভিবাসন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আসায় বাংলাদেশিসহ অবৈধভাবে প্রবেশ করা সকল অভিবাসী ও আশ্রয়প্রত্যাশীদের নতুন আইনের অধীনে কঠোর ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হবে বলে ধারণা করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের ২৮ জুন থেকে দেশটিতে ন্যাশনালিটি অ্যান্ড বর্ডারস অ্যাক্ট- ২০২২ কার্যকর হয়।
আইনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিবর্তন এসেছে বলে জানান যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সুপ্রিম কোর্টের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইনজীবী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দুটো হলো- শরণার্থীদের দুই শ্রেণিতে ভাগ করা এবং স্বয়ংক্রিয় ডিপোর্টেশন নীতি যা যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, আইনটির ধারা ১২-এর অধীনে সরকার আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন নীতি তৈরি করেছে যেখানে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা হোম অফিস আশ্রয়প্রার্থীদের অস্থায়ী শরণার্থী (আড়াই বছরের জন্য) ও শরণার্থী (বিদ্যমান ব্যবস্থায় যারা পাঁচবছর পর সেটেলমেন্টে যাওয়ার সুযোগ পান) এই দুটি ভাগে শ্রেণিকরণ করবে'।
"অস্থায়ী শরণার্থীদের ১০ বছর পর্যন্ত প্রতি আড়াই বছর পর পর ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হবে এবং এরপর তারা সেটেলমেন্টের সুযোগ পাবেন (অনিদির্ষ্টকালের জন্য)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অস্থায়ী শরণার্থীরা কমপেশনেট গ্রাউন্ডসে কারণ দর্শানো ছাড়া তাদের পরিবারের সদস্যদের স্পন্সর করতে পারবেন না। এর অর্থ হলো তারা স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের আনতে পারবেন না। তবে প্রচলিত ব্যবস্থায় শরণার্থীরা সহজেই তা করতে পারেন,' বলেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, আইনের ধারা ৪০ অনুসারে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি অফ স্টেটকে বেআইনিভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশকারী বা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও অবস্থানকারী যেকোনো অভিবাসীকে ডিপোর্টেশন বা দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আইনের ধারা ৪০ এর (এফ) অংশের (এ) ও (বি) অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষকে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি ৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। (চলতি বছরের ২৮ জুনের আগেও তা ৬ মাস পর্যন্ত ছিল)। এছাড়া যদি কেউ ১২ মাসের বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডাদেশ পান, তাহলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি অফ স্টেটকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ইউকে বর্ডারস অ্যাক্ট-২০০৭ এর ধারা ৩২(৫)-এর অধীনে ডিপোর্টেশনের আদেশ দিতে হবে।
২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের ৪৮,৫৪০টি আবেদন জমা পড়ে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা দশম, যেখানে শীর্ষে রয়েছে ইরান।
কোভিড বিধিনিষেধ ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাজ্যের হোম অফিস ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে সীমিত পরিসরে আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রাথমিক বিবেচনায় বাংলাদেশিদের সাফল্যের হার ২৭ শতাংশ, যা ইরানিদের জন্য ৮০ শতাংশ এবং পাকিস্তানিদের জন্য ৪৭ শতাংশ। আগের তুলনায় বর্তমানে বিষয়টি ভালো হয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে, তারা খুব কম আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২৭ শতাংশ আবেদন গৃহীত হয়েছে। তবে আপিলের পর তা বাড়তে দেখা গেছে।
২০২১ সালে মাত্র ২৬ জন বাংলাদেশি প্রথম আবেদনের পর যুক্তরাজ্যের হোম অফিস থেকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে স্রেফ ৭ বাংলাদেশি হোম অফিস থেকে শরণার্থীর স্বীকৃতি পায়। এর বাইরে ৩৬ জন বাংলাদেশি আশ্রয় চাইলেও তাদের অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ভিসা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর যুক্তরাজ্যের আদালত (ইমিগ্রেশন ট্রাইব্যুনাল) আগের চেয়ে বেশি আপিলের অনুমতি দিচ্ছে।
২৭ বছর বয়সী আবদুল করিম (ছদ্মনাম) মাদারিপুর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে যান।
ফেব্রুয়ারিতে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের আবেদন করেন। প্রক্রিয়াটি এখনও সম্পন্ন না হওয়ায় অপেক্ষা করছেন করিম।
'নতুন আইন কার্যকর হওয়ার আগেই আমি আবেদন করেছি। এ কারণে অ্যাসাইলাম পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী,' ৭ জুলাই ফোনালাপে টিবিএসকে জানান করিম।
'তবে ২৮ জুনের পর থেকে যারা আবেদন করছেন, তাদের জন্য নিয়মকানুন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশিদের অনেকে উদ্বিগ্ন'।
২০১৭ সালে ১,৭১২ বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করে যা ২০১৮ সালে ১,২৯৪ এবং ২০২০ সালে ৮৭৬টি ছিল।
প্রাথমিক সিদ্ধান্তের সাফল্যের হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। তবে আপিল নিষ্পত্তির পর তা বেড়ে ২৪ শতাংশের বেশি দাঁড়ায়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরবর্তী সাফল্যের হার ২৭ শতাংশ এবং আপিলের পরে তা ৩৯ শতাংশের ওপর গিয়ে পৌঁছে।
২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার। গত বছর তারা ১,৫৬০.৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়।
আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, 'যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে বৈধ বা অবৈধ সকলেই দেশের রেমিট্যান্সে অবদান রাখেন তা আমি জানি। আমার যতদূর দেখেছি, ১০-১৮ বছর বয়সী শত শত বাংলাদেশি অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বাস করছে এবং বাংলাদেশে প্রতিমাসে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অবদান রাখলেও তারা এখানকার মানসম্মত জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত'।
ইউকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ইমিগ্রেশন পলিসি নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। তবে যে কোনো অ্যাসাইলাম সিকার যদি হাইকমিশনে যোগাযোগ করে থাকেন, তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে তাকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা করা হয়য়'।
যুক্তরাজ্য কেন রুয়ান্ডায় অভিবাসীদের পাঠাতে চায়?
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল সম্প্রতি রুয়ান্ডার সঙ্গে 'মাইগ্রেশন পার্টনারশিপ' চুক্তি করেন। ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন অনুসারে, এর লক্ষ্য হলো 'যারা বিপজ্জনক, অবৈধভাবে বা প্রয়োজন ছাড়াই যুক্তরাজ্যে আসছেন তাদের জীবন উন্নত করার লক্ষ্যে স্থানান্তরিতকরণ'।
১২০ মিলিয়ন পাউন্ড চুক্তির অধীনে, রুয়ান্ডা আশ্রয় আবেদনগুলো বিবেচনা করবে এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেগুলো 'মীমাংসা বা বাতিল' করা হবে। হোম অফিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ৩০০ জনকে রুয়ান্ডায় পাঠানো হবে ধারণা করা হচ্ছে।
গতমাসে বেশ কয়েকজন আশ্রয়প্রত্যাশীকে রুয়ান্ডায় ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত হস্তক্ষেপ করলে তা বাতিল হয়।
যুক্তরাজ্য সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী তারা অনুমোদিত অভিবাসন রুট দিয়ে আসা শরণার্থীদের স্বাগত জানালেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বা চোরাচালানকারী দলগুলোকে আটকাতে চায়।
হোম অফিস প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে গত বছর অনিয়মিত রুটে অবৈধভাবে ৩৬ হাজার ৭৯২ জন যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করে।