ব্যবহার না করেই ৪ কোটি টাকার সুইমিংপুল অপসারণ!
৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ বছর আগে নির্মিত দুটি সুইমিংপুল ও একটি জিমনেশিয়াম ব্যবহার না করেই 'অনুপযোগী' ঘোষণা করা হয়েছে। স্থাপনাগুলো ভেঙে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সবুজ উদ্যান তৈরির নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) অপরিকল্পনার ফলে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে ৪ কোটি টাকা। এই অর্থের অপচয়ের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওই সময় যারা ডিজাইন করেছিলেন এবং যারা বাস্তবায়ন করেছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। তাদের থেকে ৪ কোটি টাকা ফেরত নেওয়া উচিত। যেন ভবিষ্যতে সবাই সর্তক হয়, জনগণের অর্থ ব্যয়ে যত্নবান হয়।"
চসিক ও গণপূর্ত সূত্র জানায়, গত ৬ জুলাই 'চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান স্থাপন' শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটির আওতায় সবুজ চত্বর, হাঁটার পথ ও বৃক্ষরোপণ করা হবে। এছাড়া শিশুদের জন্য খেলাধুলার স্থায়ী সরঞ্জাম ও বড়দের ব্যায়ামের সরঞ্জাম বসানো হবে। গত ২০ জুলাই সুইমিংপুলটি অপসারণে চসিককে চিঠিও দিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ।
চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সুইমিংপুলটি ব্যবহার উপযোগী করতে হলে সংস্কার করতে হবে। সব সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থাপনাগুলো অপসারণ করা হবে। কারণ একটি পার্ক করতে হলে দুই থেকে আড়াই একর জায়গার প্রয়োজন। স্থাপনাগুলো থাকলে জায়গা কমে আসবে।"
৬৯ একর আয়তনের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ২ দশমিক ২৭ একর জায়গাজুড়ে ছিল জাতিসংঘ পার্ক। ২০১২ সালে পার্কটির একাংশে দুটি সুইমিংপুল ও একটি জিমনেশিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ নেন তৎকালীন সিটি মেয়র এম মনজুর আলম। ২০১৫ সালের জুনে সুইমিংপুলটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। নির্মিত দুটি সুইমিংপুলের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট। প্রস্থ ৫০ ফুট। অন্যদিকে ৭ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে জিমনেশিয়াম ভবনটি। তবে সেখানে ব্যায়ামের কোন সরঞ্জাম ছিল না।
তবে শুরু থেকেই পার্কে স্থাপনার বিরোধী ছিল এলাকাবাসী। অপরিকল্পিতভাবে সুইমিংপুলটি নির্মাণ করা হয়েছে অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালে জাতিসংঘ পার্ককে এলিট পার্ক লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেন তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। সেখানে কমিউনিটি সেন্টার, অতিথি হাউসসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আ জ ম নাছিরের এই বাণিজ্যিক উদ্যোগ তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এবং পাঁচলাইশ আবাসিক সমিতির বাধার মুখে পড়ে আর বাস্তবায়ন হয়নি। উচ্চ আদালতের রিটে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ বন্ধ হয়।
২০১৭ সালে পার্কের মালিকানা নিয়েও সরকারি দুই সংস্থা গণপূর্ত বিভাগ ও সিটি করপোরেশন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। পরে জাতিসংঘ পার্ক সংস্কারে প্রকল্প নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। সিটি করপোরেশনের বাধার মুখে তখন তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২০ সালে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর খোরশেদ আলম সুজন গণপূর্ত অধিদপ্তরকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাপত্তিপত্র দেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর বলেন, "সুইমিংপুল বানানোর ডিজাইন ঠিক ছিল না। সুইমিংপুলে নামার আগে ও পরে গোসল করতে হয়, সে ব্যবস্থা নেই। পানি নিয়মিত বিশুদ্ধ করার কোন ব্যবস্থা নেই। সাধারণত সুইমিংপুলের গভীরতা ৪.৫ থেকে ৫.৫ ফুট হয়। কিন্তু এখানে ৮ থেকে ৮.৫ ফুট গভীরতা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নগর পরিকল্পনা বিভাগের মতামত নিতে হয়। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মতামত গ্রহণের প্রমাণ আগের নথি পাইনি।"
তবে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, "সুইমিংপুলটি পরিকল্পিতভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে। আগে পার্কের একাংশে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন গণপূর্ত বিভাগ পার্কের পুরো অংশ নিয়েই সবুজ উদ্যান প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।"
পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সেলিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা শুরু থেকেই সুইমিংপুল এবং জিমনেশিয়ামের বিরোধিতা করেছি। আমরা চেয়েছিলাম, খোলা উদ্যান, যেখানে মানুষ হাঁটতে পারবেন। শিশুরা খেলতে পারবে। সুইমিংপুলের ত্রুটি রয়েছে। এত বড় জিমনেশিয়ামের দরকার ছিল না। পার্কের এক পাশে স্থাপনাগুলো করায় অন্য পাশ একটু নিচু হয়ে গেছে। সেখানটার কোন উন্নয়ন করা হয়নি। ফলে বৃষ্টির পানি জমে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে।"
১৯৫৪ সালে ৬৯ একর জায়গা নিয়ে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে গণপূর্ত বিভাগ। ১৯৮৮ সালে সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর এ পার্কের দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে। ২০০২ সালে মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পার্কের নাম দেন 'জাতিসংঘ পার্ক'। পরে এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দুই সেবা সংস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
শুরু থেকেই পার্কে স্থাপনা নির্মাণের বিরোধী এলাকাবাসী উচ্চ আদালতের দ্বারস্থও হয়েছিলেন। ৪ কোটি টাকা অপচয় হওয়া এই প্রকল্পের পরিকল্পনা, নকশা এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মেয়র এম. রেজাউল করিম চৌধুরী কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগের বিষয়টি নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন একটি কাজ হচ্ছে। এটি শেষ হোক।"
নতুন প্রকল্পে যা আছে
মূলত নগরীর জাম্বুরি মাঠের আদলে পার্কটি করা হবে। সবুজ উদ্যানের চারপাশে সীমানা দেয়াল থাকবে। নির্মাণ করা হবে ওয়াকওয়ে। দর্শনার্থীদের বসার জন্য থাকবে বেঞ্চ। পানির ফোয়ারা, আলোকসজ্জা, টয়লেট জোন, গ্রিল দিয়ে বাউন্ডারি করা হবে। বর্তমানে পার্কটি চারপাশের রাস্তার চেয়ে প্রায় পাঁচ ফুট নিচু। ফলে বৃষ্টি হলে সেখানে পানি জমে যায়। তাই পাঁচ ফুট উচ্চতা ধরে প্রকল্পে ভূমি উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। পার্কে শিশুদের জন্য খেলাধূলার সরাঞ্জাম থাকবে। শরীর চর্চার জন্য হরাইজোন্টাল বারও স্থাপন করা হবে। থাকবে দুইটি মেটাল পারগোলাও।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, "টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।"