সরকারী হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণে এতো বিশৃঙ্খলা কেন!
ধরুন সরকারি কোন হাসপাতালের ওয়ার্ড বা বারান্দার একটি এলইডি লাইট নষ্ট হয়ে গেছে, যার দাম হয়তো ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কিন্তু নতুন লাইট লাগানোর সক্ষমতা নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। নতুন লাইটের জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এইচইডি) চিঠি লিখতে হবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। লাইটের জন্য এইচইডি টেন্ডার করবে। তাদের ফান্ডে টাকা না থাকলে লাইট ঠিক করতেও দেরি হবে।
বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে এইচইডি'র অফিস থাকায় জরুরি সমস্যাগুলোর সমাধান হলেও জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে সংকট দীর্ঘ হয়।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের কথাই ধরুন। এ হাসপাতালে গ্লাসের অবকাঠামো বেশি, এক বছর আগে ঝড়-বৃষ্টিতে হাসপাতালের ৫-৬টি গ্লাস ভেঙ্গে যায়। এইচইডির কাছে বরাদ্দ না থাকায় এক বছরেও গ্লাস লাগানো হয়নি, এতে বৃষ্টির সময় প্রায়ই পানি ঢুকে পড়ে হাসপাতালে।
উল্লেখ্য, সরকারি হাসপাতালে প্লাম্বিং, বাথরুমের ফিটিং, লাইট, ফ্যান এবং বৈদ্যুতিক তারের মতো ভাঙা বা ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামো ঠিক করার দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) বা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এইচইডি)।
কিন্তু এসব দায়িত্ব হাসপাতালগুলোর পরিচালক বা প্রধানের হাতে দিলে সংকট কিছুটা কমবে বলে মনে করেন হাসপাতালের পরিচালক ও কর্মকর্তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, "হাসপাতালে কোন কিছু নষ্ট হলে ঠিক করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। জরুরি ভিত্তিতে যে সমস্যাগুলো হয় তা পিডব্লিউডি বা এইচইডি সমাধান করে। কিন্তু ইমার্জেন্সির বাইরে যে সমস্যাগুলো হয় তা সমাধান করা কিছুটা কঠিন হয়। এতে মানুষ কাঙ্খিত যে সেবা চায় তা দিতে সমস্যা হয় আমাদের।"
'পিডব্লিউডি'র আরো অনেক কাজ থাকে। তার মধ্যে আমরা একটা অংশ। তারা যদি দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাভাবনা করে কোন কাজের প্ল্যান করে সেটি সব সময় অনুমোদন হয় না। এছাড়া তাদেরকে আমরা আমাদের প্রয়োজন সব সময় ঠিকমত বোঝাতেও পারিনা। হাসপাতালের কিছু নষ্ট হলে তার পুরো দায়িত্ব না দিলেও কিছু দায়িত্ব পরিচালক ও পিডব্লিউডি'র তত্ত্বাবধানে যদি হয়, তাহলে দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে এবং মানুষের ভোগান্তিও কমবে", বলেন তিনি।
ঢাকার চেয়ে জেলা-উপজেলায় অবস্থা আরও খারাপ। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে কোনো সিকিউরিটি গার্ড না থাকায় অধিকাংশ হাসপাতালের লাইট ও পানির কল চুরি হয়ে যায় এবং প্রতিবারই এইচইডি বা পিডব্লিউডি-কে চিঠি দিতে হয়।
ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও একই সমস্যার শিকার। এর পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নূর রিফাত আরা বলেন, "সরকারি হাসপাতালের টয়লেট পাবলিকলি ব্যবহৃত হয় বলে প্রতি সপ্তাহে কোন না কোন সমস্যা হবেই। সেই সমস্যা সমাধানে প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করানোর মতো খরচ বা ক্লিনার নেই। এসব ঠিক করতে আমাদের স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বলতে হয়। তারা বছরে একবার পরিষ্কার করে। তখন হয়তো ভাঙ্গা পাইপ ঠিক করে কিন্তু ব্লকেজ ঠিক করে না।"
তিনি আরও বলেন, "সারা বছর ধরে কোন না কোন পানির লাইন বন্ধ থাকে, পানির লাইন ফেটে যায়, কমোড ফেটে যায়, টাইলস, বেসিন ভেঙ্গে যায়। সারা বছর ধরে এ ধরণের সমস্যা থাকে। এসব রুটিন অনুযায়ী ঠিক করতে হয় আমাদের। একটা উন্নয়ন ফান্ড করে দায়িত্বটা আমাদের দিলে দ্রুত সমাধান করা যায়।"
বাড়ি আমার, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অন্যের!
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির সহকারী পরিচালক ডা. হোসেন ইমাম বলেন, "হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এইচইডি বা পিডব্লিউডি এর কাছে থাকার কারণে সমন্বয়ে সমস্যা হয়। বিষয়টা এমন যে আমাদের বাড়ি কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অন্যজনের।"
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, "এ দায়িত্ব হাসপাতাল পরিচালকদের হাতে দেয়া যায় কি-না এ নিয়ে এখনো তেমন কোন পরিকল্পনা নেই।"
তবে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ-উন-নবী বলেন, সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান সম্ভব, যদি হাসপাতালের পরিচালকদের এইচইডি বা পিডব্লিউডির সাথে আরও ভাল যোগাযোগ স্থাপন হতো।
শিক্ষাবিদ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস-এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, "আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর অবকাঠামোগত ও যন্ত্রপাতিগত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় সমস্যা রয়ে গেছে। সিভিল, ইলেক্ট্রিক্যাল, মেকানিকাল বিষয়গুলো দেখে এইচইডি, যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিন্তু এর সক্ষমতা কম। আবার পিডব্লিউডি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। বড় স্থাপনাগুলো পিডব্লিউডি তৈরি করে কিন্তু পরবর্তীতে তত্ত্বাবধান সহজ হয় না। এক মন্ত্রণালয়ের সাথে অন্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা আছে। এসব ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে।"
সরকারি হাসপাতালে এমআরআই, সিটি স্ক্যান, আল্ট্রাসাউন্ডসহ যেকোন মেশিন নষ্ট হলে তা ঠিক করে ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণ সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি)। কোন হাসপাতালে কোন যন্ত্র নষ্ট হলে পরিচালক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলেই তা ঠিক করতে পারে না। এগুলো ঠিক করতে নিমিউ-তে কয়েক দফা চিঠি লিখতে হয়, তারা সেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার পর ঠিক করে ফেরত পাঠাতে পাঠাতে অনেক সময় যন্ত্রের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়।
অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, "নিমিউ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান কিন্তু সে হারে সরকারি হাসপাতালের বিস্তার ঘটেছে সে হারে নিমিউয়ের সক্ষমতা বাড়েনি। এখন যেহেতু অনেক আধুনিক প্রযুক্তি তাই তাদের পক্ষে এতো লোক নিয়োগ করাও সম্ভব নয়। তাই সরকারের পরিকল্পনায় থাকতে হবে যাদের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি নেয়া হবে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে নিমিউয়ের অধীনে কিভাবে তদারকি বিকেন্দ্রীভূত (ডিসেন্ট্রালাইজড) করা যায়।"