রাজশাহীতে মরুর গোলাপ, স্বাগত ‘অ্যাডেনিয়াম অন্তু’র ভুবনে
শওকত হোসেন অন্তু। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে। আর পিইচডি করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে। ফলে উদ্ভিদ সম্পর্কে তার পাকাপোক্ত ধারণা আছে, এমনটি বলাই যায়।
খুব ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জাতের গাছের সাথে তার সখ্যতা। বাড়ির বারান্দায় তখন থেকেই টবে ফুল চাষ করতেন। তখন বিভিন্ন জাতের ও আকৃতির গাছ পছন্দ করতেন তিনি। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে অ্যাডেনিয়ামকেই একমাত্র গাছ হিসেবে বেছে নিয়ে তাতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। এজন্য তিনি ফুলপ্রেমীদের কাছে 'অ্যাডেনিয়াম অন্তু' নামে পরিচিত।
শুরুতে তিনি হর্টিকালচার সেন্টার কিংবা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অ্যাডেনিয়াম সংগ্রহ করতেন। এখন সেটাকেই বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছেন। নিজেই এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অ্যাডেনিয়াম আমদানি করে তা বিক্রি করেন। রাজশাহী মহানগরীর কাজলা এলাকার ছয়তলা নিজ বাসভবনের ছাদে গড়ে তুলেছেন অ্যাডেনিয়ামের বিশাল ভুবন। তার ছাদ বাগানে অ্যাডেনিয়ামের জাত রয়েছে পাঁচশোর মতো। গাছ রয়েছে ১০ হাজারের অধিক। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা হবে বলে জানান তিনি। অন্তুর দাবি, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাডেনিয়ামের সংগ্রহ তারই।
অন্তুর ছাদবাগানে গেলে মনে হবে অন্যরকম এক ভুবনে চলে এসেছেন। ছাদে উঁচু-নিচু করে সারি সারি টবে রাখা হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির ও জাতের বনসাই আকৃতির অ্যাডেনিয়াম। তাতে কোনোটিতে ফুল ধরেছে সাদা রঙের, কোনোটি গোলাপি রঙের ও কোনোটিতে লাল রঙের। ফুল দেখে মনে হবে আমাদের দেশের গোলাপের মতোই দেখতে। কথা বলে জানা গেলো, অ্যাডেনিয়াম গাছটি প্রাকৃতিকভাবেই বনসাই আকৃতির; এটি 'মরুভূমির গোলাপ' হিসেবে সুপরিচিত।
অন্তুর ছাদের একপাশে অ্যাডেনিয়ামের ভুবন। আরেকপাশে রয়েছে অর্কিড ও ক্যাকটাস। অর্কিড গাছে ফুল ধরেছে বেগুনি ও সাদা রঙের। পুরো ছাদজুড়েই যেন বিশুদ্ধতা ও মুগ্ধতার ছোঁয়া। ছাদ থেকেই পরখ করা যায় পুরো নগরীকে। পাখির চোখে শহরের আকৃতিও বুঝে নেওয়া যায়। এছাড়া পাশেই পদ্মা নদী। তার দিগন্ত বিস্তৃত রূপ যেমন ছাদ থেকে দেখা যায়, তেমনি পদ্মার শীতল বাতাস মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়।
অন্তু জানান, এপোচাইনেসি পরিবারভুক্ত গাছটি বাংলাদেশে সাধারণত শীতের পর থেকে শীতের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অবিরাম ফুল দিয়ে থাকে। ফুলের রং গোলাপি থেকে লাল ও সাদা বর্ণের। এখন অনেকে মিক্সড কালারও করছেন প্রচুর। ফুলের কারণেই বাংলাদেশে এ গাছটির চাহিদা বেশি। তবে শীতকালে গাছে কোনো ফুল ধরে না।
ওবেসাম জাতের এ গাছ ফুলের জন্য বিখ্যাত। কারণ এই জাতের গাছে গোলাপের মতো দুই থেকে তিনটি করে পাঁপড়ি ও স্তর থাকে। তবে বনসাই আকৃতি হওয়ার কারণে অনেকে শুধু গাছও পছন্দ করেন।
তবে গাছে ফুল থাকুক বা না থাকুক গাছটি বিক্রি হয় বেশ। আলাদাভাবে কখনো তিনি ফুল বিক্রি করেননি।
অন্তু জানান, অ্যাডেনিয়ামের আদি মাতৃভূমি দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার মরুভূমি, সুদান, কেনিয়া, সেনেগালের পশ্চিমাঞ্চল, ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া উদ্ভিদটি প্রাকৃতিকভাবে শ্রীলঙ্কাতেও আছে। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হচ্ছে থাইল্যান্ডে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, জাপান থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। অন্তু প্রধানত অ্যাডেনিয়ামের এসব গাছ থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করেন। এরপর তা অনলাইনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন। গাছের আকৃতি ও জাত অনুযায়ী একেকটি গাছ বিক্রি হয় ১০০ টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসে তিনি দুই থেকে তিন লাখ টাকার গাছ বিক্রি করেন। তিনি প্রধানত গাছ পাইকারি বিক্রি করেন। তবে খুচরাও বিক্রি করেন অল্প পরিমাণে।
অন্তু জানান, শুরুর দিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে একটা-দুইটা করে গাছ সংগ্রহ করলেও এখন তিনি সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করেন।
অ্যাডেনিয়ামের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের অর্কিড ও ক্যাকটাসও আমদানি করেন। এক চালানে তিনি দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজারটি গাছ আমদানি করেন। তারপর সেসব গাছ অনলাইনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেন। এজন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাছ বিকিকিনির যেসব গ্রুপ আছে সেগুলোকে মাধ্যম হিসেবেই বেছে নেন।
অন্তু জানান, বিমানে করে গাছগুলো আমদানি করা হয়। একেকটা শিপমেন্টে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার গাছ আনেন তিনি। একসাথে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার গাছ আমদানি করেছেন। সেই শিপমেন্টে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছিলো তার।
তিনি জানান, গাছ যত টাকার আমদানি করা হয় খরচও তত টাকা পড়ে। তবে বেশি টাকার গাছ আমদানি করা হলে খরচ কিছুটা কম পড়ে। গত জুন মাসের প্রথম দিকে তিনি চার লাখ টাকার গাছ আমদানি করেছিলেন। আমদানি করতে তখন তার খরচ পড়েছিলো আরও ৪ লাখ টাকা। কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ ও বিমানভাড়ার জন্য বেশি খরচ পড়ে। বছরে চার থেকে পাঁচবার তিনি বিদেশ থেকে গাছ আমদানি করেন বলে জানান।
অন্তু জানান, এখন প্রধানত গাছ আমদানি করে তা বিক্রি করা হয়। তবে স্বল্প পরিসরে গ্রাফটিংও শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে জাত তৈরি করে উৎপাদন করে বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে তার। বিশেষ করে ফুলের সঠিক রঙ আনার জন্য উৎপাদন খুবই দরকারি বলে জানান তিনি।
অন্তু জানান, অ্যাডেনিয়াম গাছটি খুবই খরা-সহনশীল। এটি কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখায় প্রচুর পানি ধারণ করে রাখতে পারে, যা খুব অল্প বৃষ্টিপাত ও খরার সময় ব্যবহার করে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারে। এর বৈশিষ্ট্য ও বাহ্যিক গঠনপ্রকৃতি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং প্রাকৃতিকভাবেই এটি বনসাই প্রকৃতির বলে খরাপ্রবণ এলাকায় টবে চাষ করার জন্য খুবই উপযুক্ত একটি গাছ। সাত-আট দিন পর টবে অল্প কিছু পানি দেওয়া ছাড়া আর তেমন পরিচর্যা লাগে না।
একটি গাছ বাঁচতে পারে ১০০ বছর পর্যন্ত। আবার মাধ্যম ছাড়াও কাণ্ডে যতদিন পানি থাকে ততদিন বেঁচে থাকতে পারে গাছগুলো। এজন্য পরিচর্যায় খরচও কম হয় বলে জানান তিনি। তিনি নিজে তো গাছের পরিচর্যা করেনই পাশাপাশি গাছের পরিচর্যার জন্য দশ হাজার টাকা মাসিক বেতনে আরও একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া সার, টব, টবের মাটি সবই ক্রয় করতে হয় তাকে। এজন্য আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সবমিলিয়ে মাসে পরিচর্যার পেছনে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয় তার। তবে ছাদে টব রাখায় খরচ কম হয়। গ্রাউন্ডে এই বাগানেই পরিচর্যার জন্য তিন থেকে চারজন লোক আরও বেশি লাগতো বলে জানান তিনি। সেক্ষেত্রে পরিচর্যার জন্য খরচও বেশি পড়তো বলে জানান তিনি।
গাছের পরিচর্যার জন্য অন্তু কোথাও প্রশিক্ষণ নেননি। তিনি বলেন, 'আমি নিজে বোটানির ছাত্র। ফলে গাছ সম্পর্কে আমার এমনিতেই ভালো ধারণা আছে। তাছাড়া কেউ দীর্ঘদিন গাছ নিয়ে কাজ করতে থাকলে গাছের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যায়। বলা যায়, কাজ করতে করতে গাছের পরিচর্যা করা শিখে যাওয়া।' তবে গাছ সম্পর্কে জানতে বই-পুস্তক ও ওয়েবসাইটের সহযোগিতা নিয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
অন্তুর ছাদবাগানে অর্কিড রয়েছে এক হাজারের মতো। একেকটি অর্কিড গাছ বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত; আবার ক্যাকটাস বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৩০০০০ হাজার টাকার। সবমিলিয়ে তার ছাদবাগানে ৫০ লাখ টাকার মতো গাছ রয়েছে।
অন্তু জানান, পেশা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের ইচ্ছা আছে তার। তবে তখনও ফুল গাছ নিয়ে থাকতে চান। ভবিষ্যতে তিনি বিভিন্ন জাতের ফুলের ফার্ম গড়ে তুলতে চান। ইতিমধ্যেই ফার্মের জন্য জমি খোঁজার কাজ শুরু করে দিয়েছেন বলে জানালেন।