এখন থেকে ৯৯% বাংলাদেশি পণ্য চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে
চীন এখন বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। এবার আরও ১ শতাংশ—অর্থাৎ মোট ৯৯ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক, পাট, চামড়াজাত পণ্য ও ফ্রোজেন ফিশের মতো প্রধান রপ্তানি পণ্যসমূহ।
রোববার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই সুবিধা পাওয়ার কথা জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। নতুন এই সুবিধা আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
রোববার সকালে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মোমেন এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, 'এক-চীন' নীতির প্রতি ঢাকা তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। আর বেইজিং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য সমাধান খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার আশ্বাস দিয়েছে।
এদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন একসাথে কাজ করতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-অবরোধ ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা-অবরোধের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এসব কারণে সারা বিশ্বের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।'
শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও বাড়ল
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (এফটিএ) অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য—তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, লেদার ও লেদারগুডস, ফ্রোজেন ফিশ, এগ্রি প্রোডাক্ট ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং—এই সব পণ্যই চীনে এখন শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'এখন এ সুবিধা আরও ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৯৯ শতাংশ করা হলে, তাতে যে পণ্যই নতুন করে যুক্ত হোক না কেন, তা রপ্তানি করার সামর্থ্য আমাদের আছে কি না, সেটাই বড় বিষয়।'
চীন ২০২২১ সালের ১ জুলাই থেকে সমস্ত পোশাক পণ্যসহ ৮ হাজার ২৫৬টি বাংলাদেশি পণ্যে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছিল। এ তালিকায় লেদার আইটেমসহ আরও ৩৮৩টি নতুন পণ্য যুক্ত করে পরবর্তীতে ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়।
বাণিজ্য তথ্য বলছে, চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি গত অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৬৮৩ মিলিয়ন ডলারে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬৮০ মিলিয়ন ডলার।
তাই বর্ধিত শুল্কমুক্ত সুবিধার সদ্ব্যবহার করা যাবে কি না, তা নিয়ে কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা সন্দিহান। কারণ বাণিজ্য তথ্য বলছে, বাংলাদেশের সীমিত সক্ষমতা ও পণ্যের গুণগত মান কম হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত সুবিধা চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রত্যাশিতভাবে বাড়াতে পারেনি।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট এটিএম আজিজুল আকিল বলেন, 'আমরা যদি আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ চীনের দেওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধার মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার ক্যাশ ইন করতে পারবে।'
এটিএম আজিজুল আকিল বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার সুফল ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশকে মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্যও আনতে হবে।
এছাড়াও চীনে মিঠা পানির মাছ ও পোল্ট্রি আইটেম রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি। সেজন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই পণ্যের মান কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে।
বেইজিংকে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বাড়াতে বলল ঢাকা
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
মোমেন বলেন, 'এই সফর রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, দুই পক্ষের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। একটি মহল চীনের শান্তি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে উসকানি দিচ্ছে, বাংলাদেশ চীনের পাশে থাকবে। তাইওয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদী, বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে অটল থাকবে।'
তাইওয়ানের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে 'এক চীন' নীতির প্রতি বাংলাদেশের অটল সমর্থনের জন্য ওয়াং ই ঢাকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বেইজিংয়ের সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা। ওয়াং ই আশ্বাস দিয়েছেন, প্রত্যাবাসন শুরু করার উপায় বের করতে চীন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা রক্ষা করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও বলেন, চীনের অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোকে গতিশীল করতে বলেছে ঢাকা।
বেইজিং থেকে নতুন ঋণ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি।
ওয়াং ই শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান কৃষিমন্ত্রী মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। রোববার দুপুরে ঢাকা ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওয়াং ই।
এই সফরে দুদেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও চীন ৪টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, স্বাক্ষরিত নথির মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সমুদ্র বিজ্ঞানে সহযোগিতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করার বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে সমর্থন অব্যাহত রাখবে চীন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠককালে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার দেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন দেবে এবং কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
ওয়াং ই প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাইওয়ান ইস্যুতে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এ সময় বাংলাদেশ 'এক চীন নীতিতে' বিশ্বাসী, এ কথা পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন: বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বকে মূল্যায়ন করে।
শেখ হাসিনা বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ চীনের সহযোগিতা চায়।
জবাবে চীনা মন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে।
ওয়াং ই আরও বলেন, 'তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হলে চীন তার ভূমিকা পালন করবে।' তিনি উল্লেখ করেন, তারা এখন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাসস্থান নির্মাণ করছে।