ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্কারোপ এড়াতে বাংলাদেশের দিকে নজর চীনা কোম্পানিগুলোর
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ, আগামী জানুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় বসার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য উচ্চ রপ্তানি শুল্ক এড়াতে চীনা কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ এখানে আনার পরিকল্পনা করছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ (ওসিএবি)- এর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন নায়ান বলেছেন, "আমি মনে, করি ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শুল্ক বাড়াতে চলেছে।"
"তাই যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রপ্তানির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের আগেই উৎপাদকদের উচিত হবে উৎপাদন ব্যবস্থা সরিয়ে নেওয়া। সুতরাং, আমরা [বাংলাদেশে] আরও অনেক বিনিয়োগ দেখতে পাব," শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনা পর্ষদের চতুর্থ অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ফাঁকে তিনি টিবিএসকে এ কথা বলেন।
তবে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলোর দিকেও ইঙ্গিত করেছেন নায়ান। বলেছেন, এদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বড় যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছেন, তার মধ্যে একটি হল জটিল আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, "আমাদের সহজ আমদানি ও রপ্তানি পদ্ধতি দরকার। যদি তারা [সরকার] এই প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ করতে পারে, তবে এটি ব্যবসা–বিনিয়োগের জন্য খুবই ভালো হবে।"
ওসিএবি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি ক্যালভিন নায়ান একটি রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল ও পোশাক কোম্পানি 'গোল্ডেন ক্রাউন এন্টারপ্রাইজেস ইন্টারন্যাশনাল'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়টি তিনি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন, এমনকি ছোটখাটো ভুল, যেমন— কোনো নথিতে টাইপোগ্রাফিক ত্রুটিও (বানান-সংক্রান্ত ভুল) রপ্তানি এবং আমদানি প্রক্রিয়া স্থগিত করে দিতে পরে। এতে উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক উভয়ই জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন।
"সুতরাং, ব্যবসাকে সহজ করে তুলতে আমাদের পদ্ধতি ও নীতিগুলোকে আরও সরল করার বিষয়ে ভাবতে হবে," যোগ করেন তিনি।
নায়ান বলেন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) বিনিয়োগকারীদের এসব উদ্বেগ নিরসনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
"বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করতে বিডার উচিত কিছু বিষয়ে শক্ত হয়ে কথা বলা। বিডা আরও সক্রিয় ভূমিকা নিলে তা ব্যবসায়ীদের উপকারে আসবে," বলেন তিনি।
গেল আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ক্যালভিন নায়ান বলেন, "বাংলাদেশজুড়ে ব্যাপক অস্থিরতা চলছে এবং আমরা আশা করি, শিগগিরই এর সমাধান হবে।"
তিনি বলেন, "সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— শ্রমিকদের এটা বুঝতে হবে, কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, তাদের চাকরিও আর থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে মালিক, বিনিয়োগকারী, সরকার ও শ্রমিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।"
অন্যদিকে, রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এটি আমাদের জন্য একটি অবাক করার মতো বিষয় ছিল। আমরা দেশে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আশা করিনি, বিশেষ করে জানুয়ারির নির্বাচনের পর। নির্বাচন হলো, তিনি [শেখ হাসিনা] জিতে গেলেন, তারপর হঠাৎ করেই শাসনব্যবস্থা বদলে গেল।"
"আমাদের জন্য [একজন চীনা বিনিয়োগকারী হিসেবে] কে ক্ষমতায় আছেন, সেটি বিবেচ্য নয়; বরং সমাজের আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে সঠিক কাজটি করতে হবে এবং আমরা যেকোনো সরকারকেই সমর্থন করব। আমরা এখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের জন্য নয়, বরং আমরা এখানে উভয় পক্ষের জন্যই একটি লাভজনক পরিস্থিতি (উইন-উইন সিচুয়েশন) খুঁজতে এসেছি।"
"আমরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করি, বিনিয়োগ করি এবং আমাদের নির্ধারিত কর পরিশোধ করি। আমরা আমাদের কার্যক্রম প্রসারিত চাই, কিন্তু সেজন্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অত্যন্ত জরুরি," যোগ করেন তিনি।
গোল্ডেন ক্রাউন এন্টারপ্রাইজেস ইন্টারন্যাশনাল ওভেন ফেব্রিকস, জ্যাকেট, প্যান্ট এবং হেডওয়্যার তৈরি করে— যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান এবং কোরিয়াসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। অর্থের অঙ্কে এই কোম্পানির বার্ষিক রপ্তানি মূল্য ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কোম্পানিটিতে মোট কর্মীর সংখ্যা ১০,০০০।
ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা সম্পর্কে ক্যালভিন নায়ান জানান, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তার তাদের সম্প্রসারণ এখন স্থগিত রেখেছেন, তবে স্থিতিশীলতা ফিরে আসলেই সামনের বছর ফের সম্প্রসারণের ইচ্ছা রয়েছে তাদের।
নায়ান বলেন, "আমি মনে করি, অন্য বিনিয়োগকারীরাও এই মুহূর্তে নতুন বিনিয়োগ করতে দ্বিধায় পড়বেন, কারণ তারাও এ বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন।"
"তবে দীর্ঘমেয়াদে আমি বিশ্বাস করি, বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসবেন, কারণ এখানকার সুযোগগুলো খুবই আকর্ষণীয়; জমি, মানুষ, সম্পদ সবই চমৎকার। এমনকি আমি এটাও বলব যে, কিছু কিছু সময় যখন অন্য কেউ আসছে না— তখনই বাজারে ঢোকার সেরা সময়," যোগ করেন নায়ান।
বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গোল্ডেন ক্রাউন এখন থেকে ৩০ বছর আগে এখানে ব্যবস্থা শুরু করে। সে সময়ও বাংলাদেশ একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছিল, যখন দেশে এ ধরনের শিল্পের অভাব ছিল।
"৩০ বছর আগে, এখানে মূলত কোনো শিল্প ছিল না, কিন্তু এখন অনেক সহায়ক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেই সময়ে, শিল্প স্থাপন করা ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু আজ দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর বড় উদাহরণ হলো— সে সময়ে আমাদের পোশাকের বোতাম পর্যন্ত আমদানি করতে হতো। আর এখন আমরা এসব আনুষঙ্গিক জিনিস স্থানীয়ভাবেই কিনতে পারছি," বলেন তিনি।
ক্যালভিন নায়ান বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে একটি মূল পার্থক্যও উল্লেখ করেছেন। তার মতে, বাংলাদেশে অনেক স্থানীয় উদ্যোক্তা রয়েছেন— যারা অত্যন্ত সফল এবং দক্ষ ব্যবসায়ী।
"মূলত এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি, এই শিল্প [পোশাক] এখানে দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে," যোগ করেন নায়ান।