ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, দুর্বল পরিকল্পনায় ব্যয় বাড়ছে চট্টগ্রামের মেগাপ্রকল্পগুলোর
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্বল পরিকল্পনার কারণে কর্ণফুলী টানেলসহ চট্টগ্রামে বাস্তবায়নাধীন তিন মেগা প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বাড়ছে আমদানি খরচ। এছাড়া দুর্বল পরিকল্পনার কারণে কাজ শেষের আগমুহূর্তে নতুন করে করতে হচ্ছে নির্মাণকাজ।
এছাড়া প্রকল্প গ্রহণের সময় প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুর্বলতা থাকা কারণেও প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।
কর্ণফুলী টানেল
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ। এই পর্যায়ে এসে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় এবং নতুন কিছু অবকাঠামো যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।
ইতোমধ্যেই প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, প্রথম দফা পুনর্মূল্যায়নের পর ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে যে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছিল তাতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরা হয়েছিল ৮০ টাকা। সবশেষ ব্যয় বাড়ানোর খসড়া প্রস্তাবে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরা হয়েছে ৯২ দশমিক ৫০ টাকা।
হারুনুর রশিদ বলেন, 'ডলারের রেট আমরা প্রস্তাব করেছি ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ এখনই রেট বেড়ে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় (আন্তঃব্যাংক লেনদেন) দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত প্রস্তাব যখন একনেকে উঠবে তখন ডলারের বিনিময় হার আরও বেড়ে যেতে পারে।'
টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে টানেল প্রকল্পের ব্যয় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ বঙ্গবন্ধু টানেল চালুর লক্ষ্যে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাজ শেষের এই মুহূর্তে এসে নতুন কিছু অবকাঠামো যুক্ত করা হচ্ছে যা আগের পরিকল্পনায় রাখা হয়নি। এ কারণে এ প্রকল্প ব্যয় অন্তত ৬০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে।
হারুনুর রশিদ জানান, টানেলের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়নের সময় বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১ কোটি টাকা। কিন্তু কাজ শুরুর পর নির্মাণকারী সংস্থা জানায়, টানেলের জন্য অন্তত ১৫ মেগাওয়াটের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন।
এ কারণে টানেলের দুই প্রান্তে দুটি সাবস্টেশন তৈরি করতে ব্যয় বেড়েছে ৮২ কোটি টাকা।
এদিকে টানেলে গাড়ি প্রবেশ করার আগে স্ক্যানারে তা পরীক্ষার পরিকল্পনা থাকলেও চুক্তিতে স্ক্যানার বসানোর বিষয়টি ছিল না। ডলার সংকটের এই মুহূর্তে সেই স্ক্যানার আমদানির জন্য বাড়তি আরও সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা লাগবে বলে জানিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া টানেলের দুপাশে থানা ভবন ও ফায়ার স্টেশন নির্মাণসহ অন্যান্য ব্যয়ও এর সঙ্গে যুক্ত হবে বলেন জানান প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প। কিন্তু গত আড়াই মাসে এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'চলতি বছরের মে-র মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের কাজের অগ্রগতি ছিল ৭০ শতাংশ। সাংহাইয়ে আটকে পড়া রেললাইনের ট্র্যাক, লুপ, অ্যাঙ্গেল, রেল স্টেশনের গ্লাস ও কক্সবাজারের আইকনিক রেল স্টেশনের ঝিনুক আকৃতির কাঠামো এখনো দেশে এসে পৌঁছায়নি। ফলে কাজ এগোয়নি। এর মধ্যে ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে এসব আমদানি পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে।
'এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু মালামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে, আবার কিছু দেশীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু ডলার সংকটে উভয় ক্ষেত্রেই পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে তারা বাড়তি পেমেন্টের জন্য চাপ তৈরি করছে।'
প্রকল্পের দোহাজারী থেকে চকরিয়া অংশের কাজের দায়িত্বে থাকা তমা কন্সট্রাকশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী বিমল সাহা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের অংশে মাত্র ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখনো বিশাল এলাকায় জমি অধিগ্রহণের কাজ বাকি। দিন যত যাচ্ছে জমির দামও বাড়ছে, এ কারণে প্রকল্পের খরচও বাড়ছে। বাড়তি টাকা না পেলে কাজ করা যাচ্ছে না।'
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতে আরও সাত-আট বছর লেগে যাবে।
এছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ আনুষঙ্গিক কারণে প্রকল্প ব্যয় আরও ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
২০১৭ সালে যখন বন্দরনগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয় প্রকল্পে অনুমোদন পায়, তখন তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ইতিমধ্যে দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি চলতি বছরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান জানান, সম্প্রতি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে সংশোধিত ডিপিপি সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
এদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয়ের সঙ্গে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা যোগ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডলার সংকটের কারণে সম্ভাব্য ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, 'আমরা ঠিকাদারদের (সংকটের) আগেই কার্যাদেশ দিয়ে দিয়েছি, তাই প্রকল্প ব্যয় বাড়ার সুযোগ নেই। তবে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঠিকাদারদের বেশি দামে নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে হবে, এটা সত্য।'
তবে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিন-এর প্ল্যানিং ম্যানেজার হাসনাইন কবির টিবিএসকে বলেন, প্রকল্পের অধিকাংশ যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
হাসনাইন কবির বলেন, 'এসব (পণ্য) আনা হয় ধাপে ধাপে। ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যেই আমাদের কাজে প্রভাব ফেলছে। এজন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে। এই খরচটা আমরা হিসাব করে প্রকল্প পরিচালককে জানাব।'
এ সময় আগেই কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, 'বাড়তি খরচ হলে সেটা তো আমাদের দিতেই হবে, নাহয় আমরা কাজ করব কীভাবে। এভাবে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা দেখা দিতে পারে।'
দুর্বল পরিকল্পনাকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন সময় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর সময় বা প্রকল্প ব্যয় সংশোধনে দেখা যায়, এসব প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইও গুণমান সম্পন্ন হয় না বলেই পরবর্তীতে এ সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
তিনি বলেন, তাড়াহুড়োর মধ্যে এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেজন্য প্রস্তুতির অবস্থা খারাপ থাকে। শেষ পর্যন্ত সময় বেশি লাগে, সঙ্গে খরচও বেশি লাগে।
কেনাকাটায় সাময়িক বিরতির পরামর্শ
শুধু চট্টগ্রামের এ তিন প্রকল্প নয়, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে দেশের প্রায় সব মেগাপ্রকল্পেই এভাবে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বর্তমান অবস্থাকে চূড়ান্ত মুহূর্ত বিবেচনা করে দেশের মেগাপ্রকল্পগুলোর জন্য কেনাকাটা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং-এর (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সুযোগ থাকলে প্রকল্পগুলো রিভিউ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থাকলে তা কাটছাঁট করার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া প্রকল্পগুলোতে নতুন করে যে বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে, সেসব যদি কিছু সময় নিয়ে হলেও বন্ধ রাখা যায় তাহলে তা বর্তমান সংকট উৎরে যেতে সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন মজুমদার টিবিএসকে বলেন, এই মুহূর্তটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটা 'সাইক্লোন টাইম'।
শুধুমাত্র মুদ্রার বিনিময় হারের কারণে ব্যয় বাড়লে পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু সময়ের জন্য মেগাপ্রকল্পগুলোর কেনাকাটা বন্ধ রাখা উচিত হবে বলে মত দেন তিনি।