এক নব বিবাহিতের যাত্রা যেভাবে শেষযাত্রায় পরিণত হলো
গতকাল উত্তরার জসিমউদ্দিন সড়কে বিআরটি-৩ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ১৫০ টন ওজনের এক গার্ডার একটি গাড়ির ওপর পড়ার ঘটনায় একই পরিবারের ৫ জন সদস্য নিহত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আড়ংয়ের উত্তরা শাখার এক কর্মচারী সাংবাদিকদের বলেন, বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে একটি ক্রেন দিয়ে গার্ডারটিকে অন্য একটি বাহনের ওপর তোলা হচ্ছিলো। ক্রেনটি অত বেশি ওজনের গার্ডার তোলার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না।
"কাজের সময় উত্তরা সেক্টর-৩ এর প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনের রাস্তাও তারা বন্ধ করেনি। হঠাৎ করেই গার্ডারের ওজনে ক্রেনটি রাস্তার পশ্চিম পাশে হেলে পড়ে। এসময় ওই গাড়ির ওপর পড়ে যায় গার্ডার," বলেন তিনি।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গাড়িটি চোখের পলকে দুমড়ে মুচড়ে যায় এবং গাড়ির তেলের সঙ্গে মিশে রক্ত বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এর চারপাশে।
গাড়ির দুই যাত্রী- সদ্য বিবাহিত দম্পতি হৃদয় (২৬) এবং রিয়া মনি (২১)-কে উদ্ধার করা হলেও বাকি যাত্রী- ঝর্ণা (২৮), তার দুই সন্তান জাকারিয়া (২) ও জান্নাত (৬), হৃদয়ের বাবা রুবেল (৫০) এবং তার শাশুড়ি ফাহিমা (৪৫) ঘটনাস্থলেই মারা যান।
বরের খালাতো ভাই রাকিব হোসেন জানান, গত শনিবার হৃদয় ও রিয়ার বিয়ে হয়। তাদের ও পরিবারের অন্যদের নিয়ে আশুলিয়ায় কনের বাড়িতে যাচ্ছিল সবাই।
"তারা সবাই দক্ষিণখানের কাওলা এলাকায় একটি বিবাহোত্তর পারিবারিক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আশুলিয়ায় কনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন সবাই। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন হৃদয়ের বাবা," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের অবশ্যই এ ঘটনাকে হত্যা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় আগেও যেমন আমরা সেগুলোকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেই, সেভাবে এটিকে দুর্ঘটনা বলা যাবেনা।"
এ ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জিয়ানশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড গ্রুপ কো লিমিটেড চায়না এবং বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছিল এ ঘটনা। প্রকল্পের শুরু থেকে নেওয়া হয়নি কোনো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।"
গার্ডারটি সরানোর সময় কোনো প্রকারের নিরাপত্তা বেড়ি দিয়ে রাস্তাটি বন্ধ করেনি বিআরটি কর্তৃপক্ষ। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ওই গার্ডারের নিচ দিয়ে যথারীতি যানবাহন চলছিল।
অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর গার্ডার অপসারণের জন্য একটি ক্রেনের ব্যবস্থা করতে বিআরটি কে জানানো হলে তারা প্রাথমিকভাবে কোনো সাড়া দেয়নি।
এর ফলে বিধ্বস্ত গাড়ি থেকে লাশগুলো বের করতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। যথাযথ ক্রেনের অভাবে উদ্ধারকারীরা গার্ডারটি সরাতে না পেরে গাড়ি কেটে লাশ বের করতে বাধ্য হয়।
সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক, উত্তরা) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক জানান, গার্ডারটি গাড়ির ওপর পড়ে যাওয়ার পরপরই রিয়া ও হৃদয় গাড়ি থেকে বের হতে সক্ষম হন।
দম্পতির অবস্থা এখন স্থিতিশীল আছে। উত্তরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তারা।
"তারা এখন স্থিতিশীল। কিন্তু তারা চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখেছে, যাদেরকে হারিয়েছে- তার তুলনায় তাদেরকে সমবেদনা জানানোর মত কোনো শব্দ আসলে নেই। পরিবারের বাকি সদস্যদের মৃত্যুসংবাদ জানার পরে থেকে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তারা দুজন," জানান রাকিব হোসেন।
এর আগে ১৫ জুলাই গাজীপুরে এই বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার সরানোর সময় রাস্তায় পড়ে গেলে এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। সে ঘটনায় এক শ্রমিক ও আরেক পথচারী আহত হন।
২০২১ সালের ১৪ মার্চ সকালে একই প্রকল্পের গার্ডার ভেঙে দুই বিদেশি নাগরিকসহ অন্তত চারজন আহত হন। এসময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, গার্ডার উঠিয়ে ফ্লাইওভারে বসানোর কাজ চলছিল; সেসময় সেটি ছিটকে পড়ে।
এর আগে ৩০ মে মিরপুর-১১-এ মেট্রোরেল নির্মাণস্থল থেকে মাহবুবুর তালুকদার (৪৯) নামক এক পথচারীর মাথায় ইট পড়লে নিহত হন তিনি। সে ঘটনায় আহত হন আরও পাঁচজন।
১০ বছর আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ইস্পাতের গার্ডার ধসে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নির্মাণকাজ চলার সময় হঠাৎ তিনটি গার্ডার ফ্লাইওভার (ওভারপাস) থেকে নিচে পড়ে যায়।
হৃদয়ের খালাতো ভাই রাকিব হোসেন বলেন, সাড়ে তিন ঘণ্টায় গাড়ির ওপর থেকে গার্ডার সরানোর জন্য কর্তৃপক্ষের ক্রেন না পাওয়া খুবই লজ্জার একটি বিষয়।
"এমনকি ঘটনার ৩০ মিনিট পরেও আমরা গাড়ির ভেতর একটি বাচ্চাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাই," বলেন তিনি।
তবে, ঘটনাস্থলে নির্মাণকাজ চলার সময় নিরাপত্তার কোনো অভাব ছিল না বলে দাবি করেন ঢাকা বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম।
"যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। একটি গার্ডারকে অন্য স্থানে নেওয়ার জন্য ট্রাকে ওঠানো হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ক্রেনটি রাস্তার দিকে সরে যায় এবং লোড বহন করতে না পেরে উল্টে যায়। সেসময় গার্ডারটি গাড়ির উপর পড়ে," টিবিএসকে বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বিআরটি বাধ্য।
"আমরা আলোচনা করে পরিমাণ ঠিক করব," তিনি যোগ করেন।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিশেষায়িত বাসের জন্য পৃথক লেন তৈরির প্রকল্পটি তিনটি সরকারি সংস্থা- সড়ক ও জনপথ বিভাগ (আরএইচডি), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ দ্বারা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনটি সংস্থার কাজের সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন তিন প্রকল্প পরিচালক।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১২ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরে কাজের এক তৃতীয়াংশও শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে, প্রকল্প সমাপ্তির মেয়াদ এবং ব্যয় উভয়ই দ্বিগুণ হয়েছে।
ধীরগতির কারণে, প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ২০৩৯.৮৪৮৯ কোটি টাকা থেকে ১০৯ শতাংশ বেড়ে ৪২৬৮.৩২ কোটি টাকা হয়েছে। এডিবিসহ তিনটি দাতা সংস্থা প্রকল্পটির জন্য ২ হাজার ৮৪২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে।