পলিথিন নয়, পাহাড়ে ব্যবহার করা হয় কলাপাতা
শাকসবজি ও বিভিন্ন তরিতরকারি তাজা রাখতে পলিথিনের বদলে কলাপাতা ও অলিপাতা (জঙ্গলে পাওয়া একধরণের লম্বা পাতা) ব্যবহার করে আসছেন পাহাড়িরা। এসব পাতায় মোড়ানো তরিতরকারি ও শাকসবজি কেজি দরে অথবা আঁটি বেঁধে বিক্রি করতে দেখা যায় পাহাড়ি বাজারে।
পলিথিন ব্যবহার না করে এভাবে কলাপাতায় মুড়ে রাখলে শাকসবজি তাজা থাকে এবং স্বাস্থ্যসম্মত হয়। তাছাড়া কলাপাতাকে ফেলে দেওয়ার পর তা মাটির সাথে মিশে গিয়ে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে মত কৃষি বিভাগের।
বান্দরবান সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'কলাপাতা ব্যবহারের সুবিধা হল এটি যে কোন শাকসবজিকে ঠান্ডা রাখে। কলাপাতায় যে স্টোমাটা (পত্ররন্ধ্র) রয়েছে সেটি পানি সংরক্ষণ ও বের করে। ফলে এটি পানির বিকল্প হিসেবে কাজ করে। যার কারণে শাকসবজি তাজা থাকে এবং স্বাস্থ্যসম্মত বলা যায়। এছাড়া যে কোন শাকসবজি কলাপাতায় মোড়ানো থাকলে দীর্ঘস্থায়ী হয়।'
পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করার কারণ হিসাবে বিক্রেতারা বলছেন, কলাপাতা ও বনজঙ্গলে পাওয়া অলিপাতা ব্যবহার করলে তরকারি ও শাকসবজি তাজা থাকে। ব্যবহারের পর এসব পাতা ফেলে দিলেও সহজে পচে যায়। পরিবেশ দূষণের কোন সুযোগও থাকছে না। তাছাড়া টাকা খরচ করে আলাদাভাবে পলিথিন কিনতে হয় না। ঘরের পাশেই সহজে পাওয়া যায় কলাপাতা আর অলিপাতা।
বান্দরবান শহরে মধ্যমপাড়ার সাপ্তাহিক মারমা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ের এমন কোন শাকসবজি ও ফলমূল নেই যা এই বাজারে পাওয়া যায় না। সাপ্তাহিক বাজার দিন রোববার ও বুধবার ছাড়াও প্রতিদিন সকাল ও বিকাল দু'বার করে এ বাজার বসে। দূর-দূরান্ত থেকে বিক্রি করতে নিয়ে আসা বেশিরভাগ তরকারি, শাকসবজি কলাপাতা ও অলিপাতায় মোড়ানো। পলিথিন ব্যাগ কম ব্যবহার করে থাকেন তারা।
বান্দরবান শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে উজিপাড়া থেকে আসা সামাচিং মারমা বলেন, 'এই সময়ে বাঁশ কোড়ল বেশি পাওয়া যায়। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে পাওয়া অলিপাতা দিয়ে আঁটি বেধে এসব বাঁশ কোড়ল বিক্রি করি। আর শাকসবজি বিক্রি করা হয় কলাপাতা মুড়িয়ে। বাঁশ কোড়ল একটু লম্বা থাকায় কলাপাতায় দেওয়া যায় না। ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।'
পলিথিন ব্যবহার না করা প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, 'পলিথিনের ভেতর শাকসবজি দীর্ঘক্ষণ রাখলে অতিরিক্ত গরমে দ্রুত শুকিয়ে যায়। তাজা না হলে ক্রেতারা কিনতে চায় না। এ কারণে বারবার পানি দিয়ে রাখতে হয়। যাতে তাজা দেখা যায়। কিন্তু কলাপাতা ও অলিপাতা হলে সহজে নরম হয় না। সারাক্ষণ তাজাও থাকে।'
সবজি বিক্রেতা চুসাংমা মারমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কলাপাতায় আঁটি বেঁধে সকালে এক থুরুং (ঝুরি) হলুদ ফুল নিয়ে এসেছি। বিক্রি এখন শেষের দিকে। হলুদ ফুল এক ধরণের শাকসবজির মত। ফুলের নরম অংশে কড়া রোদ লাগলে শুকিয়ে যায়। কলাপাতা মোড়ানো থাকলে তা থেকে রক্ষা পায়। টাটকা দেখলে ক্রেতারাও ভাল আকৃষ্ট হয়।'
'এছাড়া বনজঙ্গলে এমন কিছু লতাপাতা পাওয়া যায়, যেগুলো শুধু পাহাড়িরাই খেতে অভ্যস্ত। সেসব সবজি ও লতাপাতা কলাপাতায় মুড়িয়ে বিক্রি করতে সুবিধা। আঁটি বেঁধে বাজারে বহন করে নিয়ে আসতেও সহজ হয়। কলাপাতা যেহেতু ঘরের পাশে পাওয়া যায় সে কারণে সবকিছুতে এর ব্যবহারও বেশি হয়।'
বাজার করতে আসা একাধিক ক্রেতা জানান, কলাপাতা মোড়ানো শাকসবজি কিনতে তারাও সবসবময় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কোন শাকসবজি কলাপাতা মোড়ানো থাকলে একটু তাজাই থাকে। স্বস্তিতে কিনে খাওয়া যায়। কলাপাতা মোড়ানো সবজি বিক্রি করতে দেখলে অনেকেই সেখান থেকে বাজার করে থাকেন।
তবে কলাপাতা ও অলিপাতা দিয়ে আঁটি বেঁধে শাকসবজি বিক্রি শুধু স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশগত বিষয় নয়। এর সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের দীর্ঘদিনের পালন করে আসা ঐতিহ্য ও প্রথা জড়িত রয়েছে বলে মনে করেন হেডম্যান-কারবারি কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও তারাছা মৌজার হেডম্যান উনি হ্লা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে উনি হ্লা বলেন, 'বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কোন বড় গাছের গোড়ায় অথবা খাল-নদীর কিনারায় এখনও কলাপাতায় ফুল দিয়ে পূজা করে থাকে। চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরার লোকজন তো নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে নদীতে কলাপাতায় ফুল দিয়ে ভাসিয়ে দেয়। এর বাইরেও যার যার বিশ্বাস ও রীতি অনুযাযী বিভিন্ন প্রথাগত কাজে এই কলাপাতা ব্যবহার হয়ে থাকে।'
জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা ডা. সুমধু চক্রবর্তী জানান, পাহাড়ি এলাকার যে কোন বাজারে কলাপাতায় মোড়ানো যে শাকসবজি পাওয়া যায় সেটি পরিবেশের জন্য ভাল এবং স্বাস্থ্যসম্মত। কলাপাতাকে নির্দিষ্ট কোন জায়গায় ফেলে দিলে মাটির সাথে ভাল করে মিশে যায়। পরিবেশ দূষণ হওয়ার কারণ নেই। কলাপাতা ব্যবহার পাহাড়িদের ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। পাহাড়ে যত্রতত্র কলাগাছ ও কলাপাতা পাওয়া যায় সে কারণে কলাপাতার ব্যবহার স্বভাবতই বেশি।