‘বিএনপির আন্দোলনে হামলার ঘটনা অসাংবিধানিক’
বৃহস্পতিবার ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ শহরে আয়োজিত বিএনপির র্যালিতে পুলিশের হামলায় যুবদলের একজন কর্মী নিহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এছাড়াও একই দিনে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ দেশের আট জেলায় বিএনপির র্যালি ও সমাবেশে হামলা হয়েছে।
এছাড়াও জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদসহ গত আগস্ট মাসে দলটির শতাধিক কর্মসূচীতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা হামলা করেছে বলে দাবি করেছে দলটি। এতে দলটির তিন কর্মী নিহত হওয়াসহ আহত হয়েছে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গত ২ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৪০টিরও বেশি। এসব মামলায় আসামী হয়েছে প্রায় আট হাজার নেতা-কর্মী।
বিএনপি ছাড়াও জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ছোট ছোট বাম দলগুলোর প্রায় ২০টির মতো কর্মসূচীতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা ও পুলিশ হামলা করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদের কর্মসূচীসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে এরকম হামলার ঘটনা সংবিধানের 'সমাবেশের স্বাধীনতা' সংক্রান্ত বিধানের লঙ্ঘন।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনের নামে বিএনপি ও বেশ কিছু দল অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ফলে তারা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, 'বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই বিরোধী দলের বা উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচী চোখে পড়ছে না।
সাম্প্রতিক সরকার অবৈধভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়। এটির বিরুদ্ধে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল মাঠে নামে। কিন্তু তারা মাঠে দাঁড়াতেই পারছে না বলে মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন উত্থাপন করে ড. শাহদীন মালিক বলেন, 'কোন দেশে বাস করছি! জনগণের ভোগান্তি বা জনগণের ওপর জোর করে চেপে দেওয়া খড়গের বিরুদ্ধেও কথা বলা যাবে না।'
গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে ৩১শে জুলাই ভোলায় বিএনপির প্রতিবাদ র্যালিতে পুলিশের গুলিতে ভোলা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নুরে আলমসহ দুইজন নিহত হয়। গতকালসহ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের চারজন নেতা-কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে জানায় বিএনপি।
গত ২২ আগস্ট থেকে ঢাকার বাইরে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। এরপর থেকে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পর্যন্ত টানা ৯ দিনই বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও পুলিশকে বেশ মারমুখী অবস্থানে দেখা গেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২২ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপির ৫২ কর্মসূচিতে হামলা, ১৮ স্থানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে ৮ উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন সালিস কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যৌক্তিক আন্দোলন ও সমাবেশ করা প্রতিটি বৈধ রাজনৈতিক দলের সংবিধান সম্মত অধিকার।
'এখন এই অধিকারকে সরকার কিভাবে দেখছে, সেটি ভাবার বিষয়।'
তিনি বলেন, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে এখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয় এবং এপ্রিল মাসে আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়। জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত এবং শতাধিক আহত হয়।
সে সময় আওয়ামী লীগ বিরোধ দল হিসেবে যে আন্দোলন করেছিল, সেটি তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দেয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে নানা ইস্যুতে আরো প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ।
এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, '২০০৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার মধ্যে একটি ধারণার জন্ম হয়েছে, নাগরিকদের সমাবেশ বা আন্দোলনের স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরা হচ্ছে।'
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'বিএনপি এমনিতেই মাঠে সেভাবে রাজনীতি করতে পারছে না। তারা এখন যে কর্মসূচী দিয়েছে, সেটি জনসম্পৃক্ত একটা কর্মসূচী। সরকার কোনো আন্দোলন কর্মসূচী মেনে নেওয়ার মতো অবস্থানে নেই বলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।'
তিনি বলেন, বিএনপির এই কর্মসূচীকে সরকারে কাজে লাগাচ্ছে। শত শত হামলা হচ্ছে শত শত মামলা হচ্ছে। সেসব মামলায় বিএনপি বা যারা সরকারের বিপক্ষে কথা বলছে, এরকম হাজার হাজার মানুষকে আসামী করা হচ্ছে। এভাবে একসময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের বেশীরভাগ নেতা-কর্মী মামলার আসামী হবে। সরকার নির্বাচনের আগে এসব নেতা-কর্মীদের কারাগারে বন্দি করে, আবার একটি 'রাত্রিকালীন' বা এরকম নতুন কোনো মডেলের নির্বাচন করতে চায়।
বৃহস্পতিবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সমাবেশে সিরাজগঞ্জে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে প্রায় ২৫ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থধা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে দলটি। এছাড়াও নেত্রকোনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ২জন এএসপিসহ প্রায় ৩৫ জন আহত হয়েছে। এই ঘটনায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের ১২ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
নেত্রকোনার মদনে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হয়েছে। মামলায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি নুরুল আলমকে প্রধান করে ২৫৯ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে যুবদল কর্মী শাওন নিহতের ঘটনায় জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বানুমতি ছাড়া বিএনপি নেতা-কর্মীরা সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাদের সরাতে চাইলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে জানমাল রক্ষার্থে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শর্টগানের গুলি ছোঁড়ে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, 'বিএনপি নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার অপচেষ্টা করছে। তারা জঙ্গিদের উসকানি দিচ্ছে। এছাড়াও তারা বৈধ সরকারকে হটিয়ে অবৈধ উপায়ে আবারো ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। সরকার তাদেরকে কোনো বাধা দেয়নি। তারাই হামলা করছে সাধারণ মানুষ ও পুলিশের ওপর।'