কোভিডের পর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়লেও চিকিৎসা অপ্রতুল
কোভিড-১৯ মহামারির পর সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েছে। তবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে দেশে এখনও অবহেলিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা।
দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এখন পর্যন্ত দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই; রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটও।
তবে চলতে বছর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২ পাশ হওয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে উদ্যোগ বাড়বে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ২০২২-এর তথ্য বলছে, দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১.১৭ জন। এরমধ্যে ০.১৩ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ০.০১ জন অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ০.৮৭ জন মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সেবিকা এবং ০.১২ জন মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী।
রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আউটডোর ও ইনডোর সেবা দেওয়া হয়। এ হাসপাতালের বেড সংখ্যা এখন ৪০০। এছাড়া, ৫০০ বেডের মাত্র একটি মানসিক হাসপাতাল রয়েছে পাবনায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। দেশে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার মানসিক রোগীর জন্য শয্যা সংখ্যা ০.৪ টি। মানসিক স্বাস্থ্যে 'দিবাযত্ন' (ডে কেয়ার) চিকিৎসা-সুবিধা এখনও এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
স্বাস্থ্য নীতি অনুসারে, দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ০.৫০ শতাংশ।
মানসিক হাসপাতাল পাবনার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ আহসানুল হাবীব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য সাইক্রিটিস্ট ৩৫০ ও সাইকোথেরাপিস্ট ১০০ এর নিচে। এই চিকিৎসকেরা ঢাকা, রাজশাহী বা বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে থাকেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা একেবারে অপ্রতুল।"
রাতারাতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব না হলেও জেলা হাসপাতালগুলোতে একটি করে সাইক্রাটিস্ট পদ রাখলে অন্তত ডাক্তারের সংখ্যা বাড়বে এবং রোগীরাও সেবা পাবে বলে মত দেন তিনি।
ডাঃ আহসানুল হাবীব বর্তমানে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান। তিনি আরও বলেন, "করোনার পর বয়স অনুসারে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা বেড়েছে। করোনা মানসিক স্বাস্থ্য জগতে বেশ বড় ধরনের আঘাত করেছে। এখন বিচিত্র ধরনের রোগী আমরা পাচ্ছি, যা আগে পাইনি। করোনায় মানসিক স্বাস্থের ওপর যে আঘাত করেছে, তার প্রভাব আরো ৫ থেকে ৭ বছর পরেও পাওয়া যাবে।"
"ক্লাস করার জন্য অনলাইনে দীর্ঘক্ষণ থাকার পর শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তির অনেক বেড়ে গেছে। শিশুদেরকে পড়াশুনায় অমনোযোগী, গেম আসক্তি বেশি পাচ্ছি। তরুণেরা বাইরে কম যাওয়ায় তাদেরও গেমস খেলায় আসক্তি বেড়েছে এবং হতাশা থেকে নেশায় আসক্ত হয়েছে অনেকে। মধ্য বয়স্ক যারা কোভিড পজিটিভ ছিলেন, তাদের অনেকের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দিয়েছে। ডমিস্টিক ভায়ালেন্স বেড়ে গেছে অনেক," যোগ করেন তিনি।
দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়ারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৮-১৯ অনুসারে, দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ শতাংশ শিশুর কোনো না কোনো ধরনের মানসিক ব্যাধি রয়েছে।
জরিপ অনুসারে, মানসিক রোগে আক্রান্ত ২৪.২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা পান সরকারি হাসপাতালে, ৫.৫ শতাংশ প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছ থেকে, ৩৩ শতাংশ অন্যান্য ডাক্তারদের কাছ থেকে এবং ২.২ শতাংশ হোমিওপ্যাথি এবং ইউনানি ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, যারা পারসো-অ্যারাবিক ঐতিহ্যবাহী ওষুধ অনুশীলন করেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডাঃ ফখরুল আলম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
"সমস্যার সমাধানের জন্য প্রতিটি জেলায় মানসিক ইউনিট তৈরি করা উচিত এবং সারা দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে বিদ্যমান ইউনিটগুলোকে সেই অনুযায়ী আপগ্রেড করা উচিত," বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) বিভাগের লাইন ডিরেক্টর প্রফেসর ডক্টর রোবেদ আমিন টিবিএসকে বলেন, "দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ ছাড়াও আমরা যতটা সম্ভব হয়, সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।"
"টেলিহেলথের সাপোর্ট নিয়ে কীভাবে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের সংযুক্ত করে মানুষের সেবা দেওয়া যায়, সেজন্য আমাদের একটি পাইলট প্রোজেক্ট চলছে দুই উপজেলায়। ওই দুই উপজেলার প্রতিবেদন দেখে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। এনসিডিসি মেন্টাল হেলথের ইস্যুগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রতি বছর ডাক্তারদের ট্রেনিং দেয়," যোগ করেন তিনি।
প্রফেসর রোবেদ আমিন আরও বলেন, "কীভাবে প্রান্তিক পর্যায় থেকে রোগী স্ক্রিনিং করে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, সে ব্যাপারে কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলা সরকারের সঙ্গে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাক।"
তিনি বলেন, "কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে রোগীকে স্ক্রিনিং করে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া বা প্রয়োজনে রেফার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পেশাল ইনিসিয়েটিভ মেন্টাল হেলথের আওতায়ও চারটি জেলাকে টার্গেট করে কাজ করা হচ্ছে।"
"এখন যেহেতু মানসিক স্বাস্থ্যনীতি হয়েছে, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান হয়েছে, মেন্টাল হেলথ নিয়ে আরও কাজ হবে। এটি যেহেতু একটি বড় বিষয়, ভবিষ্যতে হয়তো আলাদা একটি অপারেশনাল প্ল্যান হতে পারে এটি নিয়ে," যোগ করেন তিনি।