রোগীর ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন
দেশের মানুষের চিকিৎসার ব্যয়ভার কমাতে রেফারের সিস্টেম চালু, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ, ওষুধের দাম কমানো, যৌক্তিক ডায়াগনস্টিক টেস্ট, দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন।
স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবের লক্ষ্যে গত ১৭ অক্টোবর ১২ সদস্যের একটি হেলথ সেক্টর রিফর্ম কমিশন গঠন করে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশিরা তাদের মোট স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ৭২.৫ শতাংশই নিজেরা বহন করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর তথ্যানুসারে, চিকিৎসার এই ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে সে বছর প্রায় ৬১ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মুখে পড়েছেন।
এই সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এখন স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন অংশীজনের সাথে কথা বলছেন। ফেব্রুয়ারির মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পলিসি ইস্যু করার ব্যাপারে সুপারিশ করবে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন।
"স্বাস্থ্য সেবাকে সহজলভ্য করতে হলে 'আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার' (নিজের পকেট থেকে করা খরচ) কমিয়ে আনতে হবে," যোগ করেন তিনি।
রেফারেল সিস্টেম এবং প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব
কমিশনের সদস্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, "আউট অব দ্য পকেট এক্সপেন্ডিচার কমিয়ে আনতে পারলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং তারা পুষ্টিতে ব্যয় করতে পারবে— যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। এটি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, চিন্তা করছি।"
তিনি বলেন, "চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য প্রয়োজন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। প্রথম কথা হলো— রোগ প্রতিরোধ করা, দ্বিতীয়ত প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিকারের ব্যবস্থা করা— এগুলো করা গেলে মানুষ অসুস্থ হবে না এবং চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে আসবে।"
ডা. মুজাহেরুল হক আরও বলেন, "আমাদের আরেকটি চিন্তা হলো রেফারেল সিস্টেম। গরিব থেকে ধনী— যে কেউ চিকিৎসা নিতে যাতে উপজেলা থেকে জেলা, বিভাগীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে আসতে পারেন।"
"কেউ যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন, এটার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। রেফারেল সিস্টেম চালু করা গেলে চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে," যোগ করেন তিনি।
এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধে ব্যয় কমাতে চিকিৎসকেরা যাতে নৈতিকতা বজায় রাখেন এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে নৈতিকভাবে ব্যবসা করে সেজন্য জবাবদিতহিতার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মনিটরিং ও সুপারভিশন শক্তিশালী করার পাশাপাশি রেফারেল সিস্টেম এবং প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতা ও তিরস্কার পুরস্কার নিশ্চিত করার বিষয়েও সুপারিশ করা হবে জানান ডা. মুজাহেরুল হক।
বিনামূল্যে সেবা ও ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ
দারিদ্র সীমার নিচে বাস করা ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি হাসপাতালে ফ্রি আউটডোর, ইনডোর সার্ভিস ও ডায়াগনস্টিক সার্ভিস রাখার সুপারিশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ জাকির হোসেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র রোগীদের জন্য ৯ শতাংশ ইনডোর ও ১ শতাংশ মেডিসিন ও ডায়াগনস্টিক টেস্ট ফ্রিতে দেওয়ার সুপারিশ করার কথা ভাবা হচ্ছে।
"সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা ফ্রিতে চিকিৎসা পাচ্ছেন কি না— উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় সব পর্যায়ে মনিটরিং ও রিভিউ অ্যাসেসমেন্টের ব্যবস্থা থাকবে," যোগ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য বলেন, "আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের প্রধান হলো ওষুধ। মানুষ ওষুধ কিনতে গেলে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। তাই ওষুধের দাম কামানো, বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারিত হওয়া উচিত।"
তিনি বলেন, "ইমার্জেন্সি প্রসিডিউর ও ক্রনিক প্রসিউর যেমন— ডায়ালাইসিস— এসব সাবসিডাইজ করা গেলে চিকিৎসার ব্যয়ভার অনেকাংশেই কমে যাবে। আমাদের দেশে সামগ্রিক অর্থনীতির ২.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যে ব্যয় হয়, এতে সরকারি ব্যয় ১ শতাংশের কম; সুতরাং সরকারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে।"
বেসরকারি খাতের সেবা মান উন্নয়ন
বুধবার (৮ জানুয়ারি) খুলনা মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য এম এম রেজা বলেন, স্বাস্থ্যখাতকে জনমুখী ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে দুইটি বিষয়ে ভাবতে হবে।
"প্রথমটি হলো সেবার পরিমাণ বাড়ানো, যাতে করে সবাই সেবাটি পায়; আরেকটি হলো ব্যক্তির আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাকে হেলথ কাভারেজের আওতায় নিয়ে আসা। এটা না করতে পারলে কিছু লোক হয়তো উন্নত চিকিৎসাসেবা পাবেন, কিন্তু একটি বড় সংখ্যক মানুষ এই সেবা পাবেন না," বলেন তিনি।
কমিশনের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতের এসব সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে সুপারিশ করা হবে বলে জানা গেছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞরাও এই সংস্কারের বিষয়ে একমত হয়েছেন এবং এ খাতের উন্নতির জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এমএইচ চৌধুরী লেলিন টিবিএসকে বলেন, "দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দারিদ্র সীমার নিচে চলে যান কয়েক লাখ মানুষ। আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধে। সরকার যদি দরিদ্র রোগীদের জন্য ওষুধে রেশনিং চালু করে– তাহলে থাইরয়েড, ডায়বেটিসের মতো যেসব রোগের ওষুধ সারাজীবন খেতে হয়– দরিদ্র রোগীরা উৎপাদন মূল্যের কাছাকাছি দামে সেগুলো কিনতে পারবে।"
তিনি বলেন, "এজন্য কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির কাছ থেকে কার্ড দেখিয়ে কম দামে দরিদ্র রোগীরা ওষুধ কিনতে পারবেন।"
"এছাড়া, দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করা ২০ শতাংশ মানুষের জন্য মেডিকেল সেফটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে– যাতে চিকিৎসা, ওষুধ, বিনামূল্যে পরীক্ষা বা কম দামে এসব সুবিধা পাওয়া যায়," যোগ করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, "আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার কমাতে সংস্কার কমিশন যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে– সেগুলোর পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি নিশ্চিতে এবং হেথল লিটারেসি বাড়াতে এসব খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।"
তিনি বলেন, "পুষ্টি ঠিকভাবে পেলে রোগ এমনিতেই কমবে। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যে হেলথ লিটারেসি বা স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে উঠলে, তারা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কম কিনবেন, এতে খরচ কমবে। আর মানুষের মধ্যে এই আচরণগত পরিবর্তন আনতে হলে স্কুল পর্যায় থেকেই স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা শেখাতে হবে।"
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন "বর্তমানে পুষ্টি এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ খুবই কম। এটা না বাড়ালে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার কমবে না। এগুলো না করে, অসুস্থ হলে শুধু ওষুধ খাওয়া বা হাসপাতাল তৈরি করেই এই খরচ কমানো যাবে না। রোগ প্রতিরোধের উপর আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।"