সীমান্ত উত্তেজনাকে ঘিরে আমদানি-রপ্তানি কমেছে টেকনাফ স্থলবন্দরে
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে গত দেড় মাসে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি উভয়ই কমেছে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পণ্য, কিন্তু আগস্টে তা নেমে আসে ১৭ হাজার ৩১৮ মেট্রিক টনে। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ২৬ দিনে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৫৮০ মেটিক টনে। এছাড়া, সেপ্টেম্বরে রপ্তানী পণ্যের পরিমাণ নেমে এসেছে ৩২০ মেট্রিক টনে; জুলাইয়ে এই পরিমাণ ছিল ৪০০ মেট্রিক টন।
টেকনাফ স্থলবন্দরের ট্রাফিক ইনসপেক্টর রামেন্দ্র বিকাশ চাকমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি জাহাজ বন্দরে আসতো মায়ানমার থেকে। কিন্তু গত দেড়মাস ধরে তিন থেকে চারটির বেশি জাহাজ বন্দরে আসছে না।"
বন্দর কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষের জেরে মিয়ানমারের মংডুতে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এ কারণে মংডু বন্দরের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের অপারেশনাল কার্যক্রম সীমিত থাকায় বাণিজ্য কমে গেছে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি যুবকের পা হারানো ও সীমান্তের জিরো পয়েন্টে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহতের পর থেকে এ পরিস্থিতির আরও বেশি অবনতি হয় বলে জানান টেকনাফ স্থল বন্দরে কর্মকর্তারা।
টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়- কুইচা মাছ, খেলনা, প্লাস্টিক সামগ্রী, গার্মেন্টস পোশাক, চিপস, অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী, ওষুধ, প্রসাধনী, চুল ও খাদ্যসামগ্রী। অন্যদিকে, মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়- কাঠ, শুপারি, আদা, হলুদ, মরিচ, পেয়াঁজ, শুটকি মাছ, পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চাল, আদা, আচার ও ছোলা।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশে থেকে আকিয়াবে রপ্তানির জন্য একটি জাহাজে ভর্তি করা হচ্ছে কুইচা মাছ ভর্তি প্যাকেট। এছাড়া, পুরো টেকনাফ বন্দরে বিরাজ করছে শুনশান নিরবতা। অলস সময় কাটাচ্ছেন শ্রমিক ও বন্দর কর্মকর্তারা।
শ্রমিকরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ টি ট্রাক লোড-আনলোড হয়, কিন্তু ওপারে যুদ্ধ পরিস্তিতির কারণে এখন পাঁচটির বেশি ট্রাক বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে না।
এ সময় ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের সিকিউরিটি এক্সিউটিভ অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, "প্রায় একমাসেরও বেশি সময় ধরে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিশেষ করে মংডুতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে কাঠ আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুন বন্দরে জাহাজ চলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে।"
অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও সীমান্তে বন্ধ নেই চোরাচালান
আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পরিমাণ কমলেও স্থানীয়দের মতে, সীমান্তে থেমে নেই চোরাকারবার। ইয়াবা, স্বর্ণসহ অন্যান্য অবৈধ পণ্য নিয়মিতই চোরাচালানের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে আসছে বাংলাদেশে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব অবৈধ পণ্য পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের একটি গোষ্ঠী রাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারে ঢুকে এসব পণ্য নিয়ে আসে। পরে দিনের বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করছে।
স্থানীয় এক গ্রাম পুলিশের এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, "এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৯০শতাংশ বাড়িতে থাকে মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা ইয়াবা, দামি সিগারেট ও স্বর্ণের বারসহ নানান চোরাই পণ্য।"
২৪ সেপ্টেম্বর রাতে টেকনাফ স্থলবন্দর সংলগ্ন বরইতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৩টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদস্যরা। এর আগে, ২১ সেপ্টেম্বর নাফ নদ থেকে ৯০ হাজার ও ২০ সেপ্টেম্বর উখিয়ার রাজাপালং থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করেছে বিজিবি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৫ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে মাদক। এর মধ্যে ১০টি কক্সবাজার এবং ৫টি বান্দরবান সীমান্তে।
তবে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ'র (বিজিবি) ৩৪ ব্যাটালিয়ানের অধিকনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদি হোসাইন বলেন, "এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের চোরাচালানের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে সীমান্তবর্তী তুমব্রু বাজারে কিছু মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে আসে এক বিক্রেতা। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই জানাগেলো সকালেই এসব মাছ মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা সরকারের সঙ্গে তাদের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর যে লড়াই চলছে তার নেপথ্যের অন্যতম কারণ হলো, সীমান্ত ঘিরে অবৈধ কারবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
"ইয়াবাসহ নানান ধরনের চোরাই পণ্য সীমান্তপথে পাচার হয়ে থাকে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো এসবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চায়। আবার জান্তা সরকার সীমান্ত কারবারের থেকে দূরে থাকতে চায় না। তাই সীমান্তে উত্তেজনা ও কড়াকড়ির মধ্যেও মাদক কারবারিরা সক্রিয় রয়েছে," যোগ করেন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম।