প্রায় শূন্য থেকে উঠে আসা চট্টগ্রামের প্যাকেজিং কোম্পানি এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক
১৯৯৮ সালের এক সন্ধ্যা; এনায়েত বাজারে পায়চারি করতে করতে ওসমান গণি দেখলেন, তাদের প্যাকেজিং কারখানার ১২ জন শ্রমিক লুডু খেলছেন। কোনো কাজ নেই তাদের হাতে।
অর্থনীতিতে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর শেষ করা ওসমান তার বাবার ঋণে জর্জরিত ব্যবসা পরস্থিতি দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন তখনই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত ফলাফলে অষ্টম স্থান অর্জনকারী ওসমান তাই অন্য কোথাও চাকরি না নিয়ে নিজেদের কারখানাটিই পুনরায় চাঙ্গা করে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কারখানাটির ওপর সেসময় ছিল ৭ লাখ টাকা বকেয়া ব্যাংক ঋণের বোঝা। এই ঋণ পরিশোধ করাই ছিল তখন ওসমানের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কী করতে চান, তা নির্ধারণ করে ওসমান তার পণ্য বিক্রির জন্য বিভিন্ন কোম্পানিতে ঘুরতে লাগলেন এবং যথেষ্ট অর্ডারও পেতে শুরু করলেন।
ব্যবসায়ে তার প্রথম ভূমিকাটি হয়ে উঠেছিল একজন সেলসম্যান হিসেবে।
ওসমান তার তিন ভাইয়ের সঙ্গে কোম্পানিটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে শুরু করলেন।
তারা হোসেন প্যাকেজিং লিমিটেড ও হোসেন বক্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামে দুটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তাদের কারখানা দুটোয় তিন শতাধিক লোক কর্মরত রয়েছেন।
তাদের কোম্পানি ইস্পানি, স্টারশিপ, আবুল খায়ের, সিনজেনটা বাংলাদেশ, কোটস বাংলাদেশ, এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড, ওয়েল ফুড এবং কিসওয়ানসহ অনেক স্থানীয় বিশিষ্ট কোম্পানির জন্য প্যাকিং সামগ্রী উৎপাদন করে।
২০২১ সাল ছিল তাদের কোম্পানির জন্য নতুন একটি মাইলফলক ছোঁয়ার বছর। এ বছর তারা আমেরিকার সুপরিচিত পোশাক কোম্পানি টমি বাহামা গ্রুপ ইনকর্পোরেটেডের কাছে প্যাকেজিং সামগ্রী রপ্তানি শুরু করে।
চট্টগ্রামে উৎপাদিত এই প্যাকেজিং আইটেমগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা এবং কম্বোডিয়াতেও রপ্তানি করা হয়।
তার কোম্পানির উৎপাদিত প্যাকেটগুলো অনেক বাংলাদেশি পণ্য যেমন- শাকসবজি ও খাবারের সঙ্গেও বিদেশে যায়।
চট্টগ্রাম এক্সপোর্ট প্রসেসিং-এর কিছু কোম্পানি, যারা আগে বিদেশ থেকে উচ্চ মানের প্যাকেজিং সামগ্রী আমদানি করতো, তারাও এখন ওসমানের কারখানায় তৈরি প্যাকিং পণ্য ব্যবহার করছে।
যে কোম্পানিটি ১৯৯৮ সালেই ধসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল, সেই কোম্পানি এখন প্রতিমাসে সরকারকে মূল্য সংযোজন কর হিসেবেই দিচ্ছে ২০ লাখ টাকার বেশি।
২০২০ সালে, তারা কারখানায় একটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় উচ্চ গতির লক বটম ফোল্ডার গ্লুয়ার, লেজার ডাই এবং অটো বেন্ডিং মেশিন স্থাপন করেছেন। তাদের কোম্পানিটি এখন অন্যান্য শিল্পের আনুষাঙ্গিক সামগ্রীর (ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাক্সেসরিজ) জন্য বৈশ্বিক হাবে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই পণ্যের বাজার ক্রমেই বাড়তে থাকায় ইউরোপের বৃহত্তম প্যাকেজিং এন্টারপ্রাইজ এএলপিএলএ বাংলাদেশে একটি প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
হোসাইন প্যাকেজিং লিমিটেড এবং হোসেন বক্স ইন্ডাস্ট্রিজের সিইও লায়ন ওসমান গণি, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে এ পর্যন্ত কোম্পানির যাত্রা, রূপান্তর এবং ভবিষ্যত লক্ষ্যগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।
কোম্পানি পুনরায় চাঙ্গা করে তোলার যাত্রা
"আমার বাবা একটি প্যাকেজিং কারখানায় কাজ করতেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে, তিনি ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে খুচরা প্যাকেজিং বক্স তৈরি শুরু করেন; তার কোম্পানির নাম ছিল এএম প্যাকেজ," বলেন ওসমান।
ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কারখানায় যেতেন ওসমান। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালীন সেই কারখানায় কাজও করেছেন তিনি।
"আমি মেশিনগুলো চালাতাম এবং কারখানার সমস্ত মেশিন চালানোর দক্ষতা তৈরি করেছি তখনই। আমি প্যাকেজিং সেক্টরের খুঁটিনাটি সবকিছু শিখেছি, কারণ এই কাজে আমি আগ্রহ পেতাম," বলেন তিনি।
বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওসমানের। তবে বাবার ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে, এটি দেখে পরিকল্পনা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
নিজের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর একটির ব্যাখ্যায় ওসমান বলেন, "তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর আমরা কাজ শুরু করতাম; কিন্তু আমি সরাসরি কোম্পানির কাছ থেকে অর্ডার পেতে মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করি।"
এরপর ১৯৯৮ সালে, তিনি বন্দর নগরীতে হোসেন বক্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং করোগেটেড কার্টন নামে একটি নতুন কারখানা চালু করেন।
"আমরা বাজারে প্যাকেজিং পণ্যের বিশাল চাহিদা দেখলাম এবং ২০০৪ সালে আমরা হোসেন প্যাকেজিং লিমিটেড স্থাপন করি। এই কারখানায় ভিন্ন ধরনের মাল্টিকালার প্রিন্টেড কার্টন তৈরির জন্য আলাদা ইউনিট রাখা হয়," যোগ করেন তিনি।
ওসমানের কাজ তখনও শেষ হয়নি। ২০০৬ সালে, তিনি একটি অফসেট প্রিন্টিং এবং পোস্ট-প্রেস ইউনিট স্থাপন করেন, যা ভোগ্য পণ্যের প্যাকেজিং বাক্স তৈরি করে।
২০১৬ সালে, হোসেন প্রোডাক্টস ইভিটেশন কার্ড (নিমন্ত্রণ পত্র) তৈরি এবং তা পাইকারি বিপণন শুরু করে।
শীঘ্রই শুরু হয় রপ্তানি এবং এরপর কোম্পানিটিকে আর কখনোই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
আরো অনেক কিছু রয়েছে করার
ওসমান তার পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কখনোই আপোস করেন না। এই বিষয়টিই তার সাফল্যের প্রধান হাতিয়ার।
"আমরা আমাদের কারখানায় একটি ওয়ান-স্টপ সলিউশন অফার করি, যা এই সেক্টরে বাজার ধরতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একটি আধুনিক ল্যাব আছে; সেখানে আমরা পণ্যের মান পরীক্ষা করি। আমরা যা কিছু করি, তা বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক পদ্ধতিতে করা হয়," যোগ করেন ওসমান।
তিনি বিশ্বাস করেন, এখনও অনেক কিছু অর্জন করা বাকি এবং সম্ভাবনাগুলোও বেশ লোভনীয়।
"আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানি করি, তবে অনেক ক্ষেত্রে এর প্যাকেজিং সামগ্রী আমদানি করা হয় অন্য দেশ থেকে; যদিও বাংলাদেশে সম্প্রতি কিছু আন্তর্জাতিক মানের প্যাকিং কারখানার বিকাশ ঘটেছে," বলেন ওসমান।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, চীন, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো দেশ থেকে প্যাকেজিং পণ্য আমদানিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে।
"যদি আমরা আমাদের প্যাকেজিং ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারি এবং ক্রেতারা যে মানের পণ্য চান তা তৈরি করতে পারি, তাহলে আমরা এর বাজার ধরতে পারবো এবং আমদানির টাকাও বাঁচবে। এই বাজারের ওপর আমাদের নজর রয়েছে। যেকোনো দেশের প্রয়োজনীয় যেকোনো ধরনের প্যাকেজিং পণ্য তৈরির জন্য আমরা আমাদের অবকাঠামো তৈরি করেছি," যোগ করেন তিনি।
ওসমান জানান, এই খাতটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
যত বেশি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হবে, বিদেশি কোম্পানিগুলো ততবেশি কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠবে। আর তখন তাদের উচ্চ মানের প্যাকেজিং সামগ্রী আমদানির প্রয়োজন হবে, মূলত এটিই টার্গেট করতে চান ওসমান।
তিনি বলেন, "আমাদের অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খাতটিও প্রসারিত হবে। আমরা কিছু কোরিয়ান ইপিজেড কোম্পানিকে প্যাকেজিং সলিউশন দিচ্ছি; এই কোম্পানিগুলো আগে এসব প্যাকেজিং সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করত, কিন্তু আমরা সেই বাজারদখল করেছি।"
"শুধু তাই নয়, আরও অনেক প্যাকেজিং পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়, এখানেও আমাদের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। উপরন্তু, আমরা আমাদের প্যাকেজিং সামগ্রী সরাসরি এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পোশাক রপ্তানিকারক ক্রেতাদের কাছেও বিক্রি করে থাকি," যোগ করেন ওসমান।
বর্তমানে কোম্পানিটি করোগেটেড কার্টন, ইনার বাক্স এবং ডুপ্লেক্স বোর্ড বক্স, উচ্চ মানের করোগেটেড বক্স, ডুপ্লেক্স করোগেটেড বাক্স, শিট এবং ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন করা বক্স, প্রিন্টিং ফোল্ডার, ফ্লায়ার এবং ক্যালেন্ডার তৈরি করছে।
এছাড়া, খাবার ও পানীয় উৎপাদনকারী কোম্পানি, তামাক কোম্পানি, ফার্মাসিউটিক্যালস, কসমেটিক এবং অ্যাগ্রোকেমিক্যাল উত্পাদকসহ আরও অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য প্যাকেজিং সলিউশন দিচ্ছে ওসমানের কোম্পানি।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারেও রয়েছে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা।
ওসমান বলেন, "আমাদের শিল্পাঞ্চলে এ ধরনের কারখানা নির্মাণের জন্য সরকার যদি একটি শিল্প প্লট আকারে সহায়তা দেয়, তাহলে বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।"
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, নিজের বাবার কারখানাকে চাঙ্গা করে তুলেছিলেন ওসমান; আর এখন ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন দিগন্ত অন্বেষণের পথে হেঁটে চলেছেন তিনি।