ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ স্থাপনে পার্টেক্স ক্যাবলসের চোখ এখন বিদেশি বিনিয়োগের দিকে
ক্যাবল উৎপাদনের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো কাঁচামাল সরবরাহকারী শিল্পকারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কংগ্লোমারেট পার্টেক্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির অধিভুক্ত পার্টেক্স ক্যাবলসের জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা স্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগের সন্ধান করছে তারা।
এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় বাজারে এবারই প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠান ক্যাবল তার উৎপাদনের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বলতে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ চক্রের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোনো পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা।
ক্যাবল উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রধান কাঁচামাল হলো তামা, রাবার, অ্যালুমিনিয়াম, থার্মোপ্লাস্টিক ইত্যাদি। এসব কাঁচামাল পারটেক্সের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে প্রক্রিয়াজাত করা হবে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে কয়েকজন জাপানি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা করছে, যারা ক্যাবল উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের জন্য পারটেক্স কেবলসকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবে।
পার্টেক্স ক্যাবলস লিমিটেডের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার রাকিব আহমেদ বলেন, এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হবে যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানিটিকে মূল্যায়ন করতে পারে।
ক্যাবল শিল্পের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান পার্টেক্স ক্যাবলস অভিহিত মূল্য বা ফেস ভ্যালুতে তিন কোটি শেয়ার ইস্যু করে ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতিতে ৩০ কোটি টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা করেছে।
'সম্ভাব্য বৈদেশিক বিনিয়োগ অনুসন্ধানে আমাদের একটি প্ল্যাটফর্ম দরকার। এছাড়া ব্যবসা বিস্তারে সহযোগীও খুঁজছি আমরা। এ ধরনের ব্যবসায়িক অংশীদাররা কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি এর মধ্যে অন্যতম,' বলেন তিনি।
'তালিকাভুক্ত হয়ে আমরা টেকসই ব্যবসার মাধ্যমে কোম্পানির সুনাম ধরে রাখতে চাই' যোগ করেন রাকিব আহমেদ।
২০১৬ সালে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও)-র তহবিল কার্যকরী মূলধন ও বিএমআরই (ভারসাম্য, আধুনিকায়ন, সংস্কার ও সম্প্রসারণ)-এর জন্য ব্যবহার করতে আগ্রহী।
ক্যাবল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছর ১০ শতাংশ নিট মুনাফাসহ ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে।
সিবিসি ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড কোম্পানির সহযোগী বিনিয়োগকারী হিসেবে কাজ করবে। এর লক্ষ্যে সংস্থাটি ইতোমধ্যে এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
পারটেক্স স্টার গ্রুপ দেশের অন্যতম বৃহত্তম ও বহুমুখী বেসরকারি উদ্যোগ। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। এম এ হাসেম ছিলেন এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানটির আরেক অঙ্গ সংস্থান স্টার অ্যাডেসিভ লিমিটেডও পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত।
প্রতিষ্ঠানটির অধীনে উত্পাদন, পরিষেবা ও ট্রেডিং সংশ্লিষ্ট ২০টি ব্যবসা পরিচালিত হয়। গ্রাহকদের তারা সেরা দামে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য ও পরিষেবা দিয়ে থাকে।
দেশব্যাপী বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ও আবাসন খাতসহ ক্রমবর্ধমান শিল্পকারখানার কারণে বাংলাদেশে ক্যাবল তারের বাজার প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে দেশীয় ক্যাবল বাজারের আকার দুই হাজার কোটি টাকা থেকে ১২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ক্যাবলের কাঁচামালের চাহিদাও প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার, যার ৮০ শতাংশ আমদানি করা হয়ে থাকে।
ক্যাবল খাতের দুই বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বিআরবি কেবল ও বিবিএস ক্যাবলসসের আপাতত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে দেশে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা থাকলে ক্যাবল শিল্পের আরও উন্নতি হতো বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
এই খাতে বড় বড় ব্র্যান্ডসহ ১২০টিরও বেশি কোম্পানি মোটা বিনিয়োগ করেছে, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান।
তবে সরকারি প্রকল্পে আমদানিকৃত ক্যাবল ব্যবহারের কারণে স্থানীয় ক্যাবল নির্মাতারা অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দীর্ঘদিন ধরে দেশের ক্যাবল বাজারে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। স্থানীয় বাজারের ৫০ শতাংশের বেশি তাদের দখলে। সব ধরনের ক্যাবল ও ক্যাবল অ্যাডাপ্টার উত্পাদন করে বিআরবি। প্রতিষ্ঠানটিতে সরাসরি ১০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে।
ক্যাবল কোম্পানিগুলো চিলি, চীন, ভারত, ওমান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে শুল্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে থাকে।
শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাবল প্রস্তুতকারক বিবিএস ক্যাবলস ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৪৭ কোটি টাকার ক্যাবল বিক্রি করেছে। এছাড়াও শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত না থাকা কোম্পানির দ্বিতীয় ইউনিটটিও একই বছরে ৪০০ কোটি টাকার টার্নওভার অর্জন করে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে অন্তত সাত ধরনের বৈদ্যুতিক তার রয়েছে। এদের দামেও পার্থক্য আছে।
উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা জানান, স্থানীয় নির্মাতারা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ক্যাবল আনা হয়।
ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের পণ্য বিভিন্নভাবে মিথ্যা ডিক্লেয়ারেশন বা ডিক্লেয়ারেশন ছাড়াই বাজারে আসে বলেও অভিযোগ তাদের।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় নির্মিত ছোট কারখানাগুলো নিম্নমানের নন-ব্র্যান্ডেড ক্যাবল উৎপাদন করছে, যেগুলো বাজারের প্রায় ১০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে।
বিআরবি, বিবিএস ও পারটেক্সের পর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিজলি ক্যাবলস দেশের বাজারে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
সরকারি প্রকল্পে স্থানীয়ভাবে তৈরি তার ব্যবহার করার দাবিও জানিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।
নগরীতে তারের জঞ্জাল কমাতে সরকার সব শহরে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে।
দেশীয় ইলেকট্রিক জায়ান্ট ওয়ালটন গ্রুপও সম্প্রতি ক্যাবল খাতে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ধীরে ধীরে সব ধরনের ক্যাবল উৎপাদন শুরু করা।
ওয়ালটন ও পারটেক্স গ্রুপ ছাড়াও অ্যালকো গ্রুপও ক্যাবল খাতে নতুন বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে।