কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানির ‘হেলথ সার্টিফিকেট’ পেতে কমছে ভোগান্তি
কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানির জন্য 'হেলথ সার্টিফিকেট' প্রদানের কাজ এখন থেকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিবর্তে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) করবে। একক কর্তৃপক্ষকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়ায় একদিকে যেমন রপ্তানিকারকদের ভোগান্তি কমবে, অন্যদিকে পণ্যের গুণগত মানের বিষয়েও প্রশ্নের কোনো সুযোগ থাকবে না।
ইপিবি এতদিন পণ্যের নমুনা পরীক্ষার যে কাজটি অনেকটা এলোমেলোভাবে সম্পন্ন করে আসছিল, তা এখন থেকে নিজেদের ডেডিকেটেড ল্যাবরেটরিতে সম্পন্ন করবে বিএফএসএ।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এএইচএম আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেন, আন্ত:মন্ত্রণালয়ের সভা অনুযায়ী, বিএফএসএকে সার্টিফিকেট ইস্যু করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর বিএফএসএ একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে সার্টিফিকেট ইস্যুর জন্য।
রপ্তানিকারকদের ইপিবির কাছ থেকে পণ্যের হেলথ সার্টিফিকেট পেতে কিছুটা ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। কারণ অনেক আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের গুণমান পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি ইপিবির কাছে নেই।
ফলে রপ্তানিকারকদের চূড়ান্ত সার্টিফিকেটের জন্য ইপিবি-তে রেজাল্ট জমা দেওয়ার আগে দেশের এবং বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণাগারে পণ্যগুলোর গুণমান পরীক্ষা করতে হতো। রপ্তানিকারক বা আমদানিকারক দেশ, কারও জন্যই সহজ ছিলনা এ প্রক্রিয়া।
তাই এখন থেকে একটি একক কর্তৃপক্ষ বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করবে, পরীক্ষা করবে এবং সার্টিফিকেট দেবে। ইপিবি এবং বিএফএসএ সূত্রে জানা গেছে, ল্যাব টেস্টে যদি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো উপাদান পাওয়া যায়, তাহলে সেই পণ্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হবে না।
ইপিবি বলছে, সব পণ্যের ক্ষেত্রে এই সার্টিফিকেট দরকার হয় না। কোনো আমদানিকারক দেশ যখন হেলথ হ্যাজার্ডবিহীন পণ্যের নিশ্চয়তার জন্য সরকারি সংস্থার সার্টিফিকেট চায়, তখনই এটি প্রদান করা হয়।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্যের হেলথ সার্টিফিকেট চায়, যেন তারা নিশ্চভিত হতে পারে পণ্যগুলো মাইক্রোবায়াল প্যাথোজেনমুক্ত।
পকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে নারিকেল তেল রপ্তানি করবে ম্যারিকো বাংলাদেশ। আমদানিকারক দেশের শর্ত হলো- নারিকেল তেলের মধ্যে যেন কলেরার কোনো জীবাণু না থাকে এ বিষয়ে সরকারের কোনো একটি সংস্থার সার্টিফিকেশন থাকতে হবে। কারণ ওইসব দেশে নারিকেল তেল খাদ্য পণ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
আরও দুটি প্রতিষ্ঠান ইউরোপের বাজারে তিলের তেল রপ্তানি করতে চায়। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেরই এখন শর্ত হলো- এই তেলে মাইক্রোবায়াল কোনো রেসিডিউ (অবশিষ্টাংশ) থাকা যাবে না। মাইক্রোবায়াল রেসিডিউ না থাকার প্রমাণ হিসেবে পরীক্ষা করে একটি সার্টিফিকেট তাদেরকে দিতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্যে ভারি ধাতু, কীটনাশকের রেসিডিউসহ মাইক্রোবায়াল নানান সমস্যা মাঝেমধ্যেই ধরা পড়ছে। সম্প্রতি দেশের দুইটি কোম্পানির চিনিগুড়া চাল ও মুড়িতে কীটনাশকের রেসিডিউ পাওয়া গেছে সুইডেনে। এ ঘটনায় ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের এই পণ্য দুটি রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক ব্র্যান্ডিং হয়েছে। এসব কারণে এখন অনেক দেশই সরকারি সংস্থা দ্বারা পণ্যের মান পরীক্ষার সার্টিফিকেশন চাচ্ছে।
মূলত এ কারণেই সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পণ্য পরীক্ষার পর সার্টিফিকেট ইস্যুর দায়িত্বটি বিএফএসএ কে দেওয়া হয়। খাদ্যপণ্যের হেলথ হ্যাজার্ড নিয়ে বিএফএসএ কাজ করে বলেই তাদেরকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিএফএসএ'র সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম টিবিএসকে বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সোমবার (৭ নভেম্বর) আলোচনা হয়েছে। তাদের পরামর্শগুলো নিয়ে দ্রুত নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে সার্টিফিকেট প্রদানের কাজ শুরু করা হবে।
রপ্তানির জন্য পণ্য কন্টেইনারে লোড করার পর স্যানিটারি অফিসাররা এলোমেলোভাবে (র্যান্ডম) নমুনা সংগ্রহ করবেন। নমুনাগুলো সিল করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দ্রুত সার্টিফিকেট সরবরাহ এবং এরপরই পণ্যগুলো শিপমেন্টের জন্য অনুমতি দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আব্দুল আলীম আরও বলেন, পরীক্ষার পরপরই সনদের একটি কপি বিএফএসএ'র ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে, যাতে আমদানিকারক দেশ এবং আমদানিকারক সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সার্টিফিকেটের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে।
তবে ল্যাব টেস্ট ফি এবং নমুনা পরিবহন খরচ রপ্তানিকারক কোম্পানিকে বহন করতে হবে বলে জানান তিনি।
প্রাণ আরএফএফ গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, "হেলথ হ্যাজার্ডের বিষয়ে নিশ্চিত হতে অনেক দেশই নির্দিষ্ট পণ্যের বিপরীতে একটা সার্টিফিকেশন চায়। ল্যাব টেস্ট করে বিএফএসএ এই সর্টিফিকেট প্রদান করলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে। কারণ অনেক টেস্টের জন্য আমাদের দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ল্যাবে ঘুরতে হয়।"
এ বিষয়ে অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টার,বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর), এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেড, ওয়াফেন রিসার্চ ল্যাবসহ বিভিন্ন ল্যাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেছে বিএফএসএ।
এ সভায় ল্যাবের প্রতিনিধিরা বলেছেন, রপ্তানি পণ্য দ্রুত ল্যাব টেস্টেরর জন্য একটি সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট করতে হবে।
দেশীয় ও রপ্তানি উভয় বাজারেই কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে আচার, মশলা, সুগন্ধি চাল, চিকন চাল, চা, চানাচুর, চিনাবাদাম, সরিষার তেল, বিস্কুট, চ্যাপ্টা চাল, ময়দা, ঘি ও নুডুলস।
২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ১৬২.২৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।