চড়া দাম পশুখাদ্যের, লোকসানের মুখে গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে ডেইরি-পোল্ট্রি খামার
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার তুলাতলী গ্রামের ডেইরি খামারি জসিম উদ্দিন। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া খামারটিতে ১৫টি গাভি থেকে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১৬০ কেজি দুধ পান। খামার পর্যায়ে প্রতি লিটার দুধ ৫৪ টাকা দরে বিক্রি করে তার আয় মাসে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
জসিম উদ্দিন জানান, খাদ্য, ওষুধ, শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলে খামারটির মাসিক খরচ মূলধনী সুদ যোগ করলে মোট খরচ দাঁড়ায় ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। করোনাকালীন সংকট, করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এভাবে প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে এই উদ্যোক্তা বলেন, 'এই অবস্থায় খামার টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই গত শুক্রবারে ৫টি গাভী বিক্রি করে দিয়েছি। খুব দ্রুত বাকি গরুগুলোও বিক্রি করে মূলধনটা টিকিয়ে রাখার চিন্তা করছি এখন।'
করোনার সময় প্রবাসে (ওমান) চাকরি হারান চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার দুরদুরী গ্রামের সন্তোষ ঘোষ। কিছুদিন বেকার থাকার পর ২০২১ সালের শুরুতে ধারদেনা করে গ্রামে একটি ডেইরি খামার দেন। কিন্তু গত সপ্তাহে ৮টি গাভী বিক্রি করে পুরো খামার বন্ধ করে দেন।
কারণ জানতে চাইলে এই যুবক বলেন, 'দুধ বিক্রি করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে গরুর খাবার কিনতেই হিমশিম খেতে হয়। তাই গরু বিক্রি করে খামার বন্ধ করে দিয়েছি।'
চট্টগ্রামের পটিয়ার দেশ অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম স্বপন বলেন, 'টিকে থাকতে খামারের গরুর সংখ্যা কমাচ্ছি। মোট ১০টি গরুর ৫টি বিক্রি করে দিয়েছি। খামার বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই চলে।'
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মালিক মোহাম্মদ ওমর টিবিএসকে বলেন, "দুধের বড় ক্রেতা হলো মিষ্টির কারখানাগুলো। পাইকারি পর্যায়ে এসব কারখানায় বর্তমানে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করতে হয় ৬৫-৬৮ টাকায়। কিন্তু শহরের ডেইরি ফার্মগুলোতে প্রতি লিটার দুধে উৎপাদন ব্যয় ৭০ টাকা। গ্রামে লিটার প্রতি উৎপাদন ব্যয় ৫৫-৬০ টাকা হলেও বিক্রয় মূল্য ৫৪-৫৫ টাকা। এখন খাদ্যের দাম আরো বেড়ে চলেছে। খাদ্যের দাম বাড়লেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দুধের দাম সেভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে লোকসানে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। তিন বছরে গরুর দুধ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ। কিন্তু দুধের দাম বেড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ।"
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, "করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চলমান ডলার সংকটে খাদ্যের দামবৃদ্ধিতে এই পর্যন্ত মোট খামারের প্রায় ২০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে।"
তিনি আরো বলেন, "খামারগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে গো-খাদ্যের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। সব পণ্য নয়, অন্তত ভুষি ও সয়াবিনে ভর্তুকি দিতে হবে।"
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে মোট ৪ লাখ ২০ হাজার গবাদিপশুর খামার রয়েছে। এসব খামার থেকে বছরে ১৩০ দশমিক ৭৪ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়। এছাড়া দেশে কোরবানির গবাদিপশুর চাহিদা মোট ৯৭ লাখ। তা শতভাগ পূরণ করছে খামারগুলো।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার শাখা) জিনাত সুলতানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মূলত খাদ্যের দামের সঙ্গে বিক্রয়মূল্য সমন্বয় করতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা সেদিকে নজর দিয়েছি। দেশে বিকল্প উৎস থেকে খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা রয়েছে।"
পোল্ট্রি
খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে ডেইরি ফার্মের মতো প্রভাব পড়েছে পোল্ট্রি খাতে। গত তিন বছরে পোল্ট্রি ফিডের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১২০০ টাকা বেড়ে ৩২০০ টাকা হয়েছে।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার মেসার্স জব্বারিয়া পোল্ট্রি ফার্মের উদ্যোক্তা আলমগীর বলেন, বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১১৫-১২০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা। উৎপাদন খরচ বাড়লে সে অনুপাতে মুরগির দাম বাড়াতে পারছে না খামারিরা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লিটন চৌধুরী বলেন, "উৎপাদন খরচ বাড়লেও মুরগির দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। দাম বাড়ালে মানুষ মুরগি খাবে না। ফলে আরো বেশি খামার বন্ধ হবে।"
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এরমধ্যে ৮৬ হাজার ৯২৭টি নিবন্ধিত। এই খাত থেকে বছরে ২ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৩৫ কোটি ডিম এবং ৩৮ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদিত হয়। দেশের চাহিদার শতভাগ পূরণ হয় এখান থেকেই।
কাঁচামাল, ডলার সঙ্কটকে দায়ী করছে ফিড ইন্ডাস্ট্রি
খামারি আর খাদ্য ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত তিন বছরে সকল পশুখাদ্যের দাম ৫০% থেকে ২৫০% পর্যন্ত বেড়েছে।
পশুখাদ্য হিসেবে বেশি চাহিদা রয়েছে গমের ভুষির। পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রতি বস্তা (৩৫ কেজি) গমের ভুষি বিক্রি হচ্ছে ১,৯৫০ টাকায়। যা ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ৭৮০ টাকা।
অন্যান্য খাদ্যের মধ্যে মসুরের ভুষি, ছোলার ভুষি, মটর ভুষি, ভুট্টা গুঁড়া, রাইস পলিশ/আটাকুঁড়া, সয়াবিন খৈল, সরিষার খৈল, মুগডালের গুঁড়া ও লবণের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকহারে।
খাতুনগঞ্জের চাক্তাই এলাকার পশুখাদ্য বিক্রেতা মেসার্স মাহী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুল আলম বলেন, "পণ্যের দাম বাড়ায় বিক্রিও কমে যাচ্ছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ২০০-২৫০ বস্তা পণ্য বিক্রি হতো। এখন তা ৫০ এ নেমেছে।"
খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এগ্রো টেক ফিডস লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শাহ জালাল বলেন, "বাজারে খাদ্যের কাঁচামাল ভূট্টা, সয়াবিনের খৈলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। গত সপ্তাহে বাজারে প্রতিকেজি ভুট্টা ছিল ৩৬-৩৭ টাকা। যা এখন ৪৩ টাকা। এমনকি অনেক কাঁচামাল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করেও আমরা ৮ লাখ ডলারের ভূট্টার এলসি করতে পারিনি। এভাবে চলতে থাকলে কাঁচামাল সংকটে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো এগ্রো খাতে।"
কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইহতেশাম বি শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েই চলেছে। স্থানীয় যোগানদাতারাও সুযোগ বুঝে দাম বড়িয়ে দিয়েছে। সয়াবিন মিলের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে অন্তত ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
ব্যাংক এলসি খুলছে না জানিয়ে তিনি বলেন, "ডলারের সংকট থাকায় ব্যাংক এলসি খুলতে চাইছে না। তবে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে অনেক ফিড মিল বন্ধ হয়ে যাবে।"
প্রাণীখাদ্য উৎপাদনের প্রধান উপাদান সয়াবিন মিল। ভুট্টা, চালের কুঁড়া, আটা, ফিশ মিল, ময়দা, সরিষার খৈল, তেল, ভিটামিন ও মিনারেল ইত্যাদি ফিড তৈরীর কাঁচামাল, যার বড় অংশই আমদানি করতে হয়।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে পোল্ট্রি ও মৎস্য চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন মাত্রা পেয়েছে ফিড ইন্ডাস্ট্রি। যার দরুণ, মহামারির আগের প্রতি বছর ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ১২-১৫ শতাংশ।
২০২০ সালে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর লকডাউনে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বড় সংকটে পড়েছিল এ শিল্প। ওইসময়ও কাঁচামালের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
তবে মহামারি পরিস্থিতির উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে ২০২১ সালে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এই শিল্পখাত।
পুঁজিবাজারের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত তিনটি কোম্পানীর (আমন ফিড, ন্যাশনাল ফিড এবং ইনডেক্স এগ্রো) আর্থিক অবস্থাও বলছে, বর্তমানে ফিড ইন্ডাস্ট্রি খাতে ব্যবসার চিত্র ভালো নয়।
তাদের প্রকাশিত তথ্যমতে, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছর ভালো মুনাফা করতে পারেনি তারা।