ঘরের চাহিদা মেটানোর ছোট্ট উদ্যোগ থেকে দুগ্ধজাত পণ্যের ব্র্যান্ড বারাকা ফার্মইয়ার্ড
ভেজাল দুধের ভয়ে পরিবারের সদস্যের গরুর দুধের চাহিদা মেটাতে কেনা হলো দুটো গরু। চট্টগ্রামের দুগ্ধজাতীয় পণ্যের ব্র্যান্ড বারাকা ফার্মইয়ার্ড-এর শুরুর গল্পটি এমনই। কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্সির স্বত্ত্বাধিকারী খুররাম নাঈমের উদ্যোগে বছর পাঁচেক আগে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটির গরুর দুধ, টক দই, মিষ্টি দই ও মাঠার জনপ্রিয়তা বাড়ছে চট্টগ্রামজুড়ে। দুগ্ধজাতীয় পণ্যের পাশাপাশি দেশি গরু পালন এবং মুরগির ডিম বিক্রির জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সমন্বিত খামার।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যায় প্রায় ২৯০ শতক জমিতে করা হয়েছে বারাকা ফার্মইয়ার্ডয়ের সমন্বিত খামার। বর্তমানে খামারের ৬৫টি গাভী থেকে দৈনিক এক হাজার থেকে ১১শ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়।
এর মধ্যে ৬০০–৭০০ লিটার দুধ প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হয়। বাকি দুধ দিয়ে দই ও মাঠার মতো দুগ্ধজাতীয় পণ্য তৈরি করে বারাকা ফার্মইয়ার্ড। এছাড়া খামার থেকে দৈনিক ১৪–১৫ হাজার মুরগির ডিম সরবরাহ করা হয় বাজারে।
গত তিনবছরে ঈদুল আজহাসহ বছরের অন্যান্য সময় এ খামার থেকে প্রায় আড়াই শতাধিক গরু বিক্রি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানান, খামার থেকে মাসে প্রায় তিনলাখ টাকা আয় হয়। এ পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ করেছেন প্রায় আটকোটি টাকা।
বারাকা ফার্মইয়ার্ড-এর স্বত্ত্বাধিকারী খুররাম নাঈম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের বাড়ি শহরে। শখ থেকে বাবার কেনা কর্ণফুলী উপজেলায় ৩২ শতক জমিতে আমি একটি ঘর করেছিলাম। পুকুর কেটেছিলাম। মা বললেন ওই জমিতে যেন গাভী পালন করি দুধের জন্য।'
২০১৮ সালে দুটি গাভী ও চারটি দেশি গরু নিয়ে যাত্রা শুরু করেন খুররাম। 'গাভী দুটি দৈনিক ৩০ লিটার দুধ দিত। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ছিল মাত্র এক লিটার। এরপর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছেও অবশিষ্ট দুধ বিক্রি করতে থাকলাম। এভাবেই চাহিদা বাড়তে থাকল, আমিও খামার বড় করতে লাগলাম,' বলেন এ উদ্যোক্তা।
করোনাকালে হোম ডেলিভারি সার্ভিসে জনপ্রিয়তা
কোভিড-১৯ মহামারির লকডাউনের সময় যখন সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল, তখনও অনলাইনে অর্ডার নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো বারাকা ফার্মইয়ার্ডের দুধ। খুররামের সিঅ্যান্ডএফ সেবার যানবাহনে করেই দুধ পরিবহন করা হতো। সংকটকালীন সময়েও মানুষের চাহিদাপূরণ করায় আস্থা অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি।
খুররাম নাঈম জানান, অনেক সময় নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে করেও দুই কেজি দুধ ও এক ডজন ডিম গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এ কারণে তখন অনেকে হাসাহাসি করত। কিন্তু নিজের পণ্য গ্রাহকের কাছে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করাতে হাসি-ঠাট্টা কানে তোলেননি তিনি।
'গাড়িতে করে যখন দুধ ডেলিভারি করতাম, তখন স্থানীয় দোকানদারেরা আস্থা নিয়ে বারাকা ফার্মইয়ার্ডের দুধ বিক্রি করতে আগ্রহী হতে থাকে। এভাবে অলিগলিতেও পৌঁছাতে সহজ হয়,' বলেন খুররাম।
দুধের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খামারের গাভীর সংখ্যা বাড়ানো হয়। পাশাপাশি খামারের ১৬ শতক জমির আশপাশের জমি কিনতে কিনতে বর্তমানে ২৯০ শতক হয়েছে। ২০২৩ সালে ৩৫টি দেশি গরু ঈদুল আজহার মৌসুমে বিক্রি করে বারাকা।
দুধের অপচয় রোধে দুগ্ধজাত পণ্য
রমজান মাসে দুধের চাহিদা তুলনামূলক বেশি থাকে। ঈদের পর আবার তা কমে যায়। ২০২১ সালের রমজানে দৈনিক প্রায় দেড়শ লিটার দুধ বিক্রি হতো বারাকা ফার্মইয়ার্ডের। কিন্তু ঈদের পর গ্রাহকেরা গ্রামে যাওয়ায় চাহিদা নেমে আসে ৭০–৮০ লিটারে। দুধের অপচয় ঠেকাতে দুগ্ধজাত দই তৈরির উদ্যোগ নেন খুররাম। ২০২২ সালের শুরুতে তা বাজারে আনেন। ২০২৩ সালের শেষদিকে বাজারে আনা হয় মাঠা।
খুররাম বলেন, 'প্রত্যেকটি পণ্যের গুণগত মানের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। খামারের প্যাকেটজাত দুধ আমার পরিবার খাচ্ছে। আমাদের দই বাজারে আনার আগে অনেকদিন পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করে আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া হয়েছিল। দইয়ে পানি আসা, সর পাতলা হওয়াসহ সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে বাজারে ছাড়া হয়।'
দুগ্ধজাত পণ্য বাড়ানো ও প্রচারের পরিকল্পনা
তীব্র গরমে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা কমলেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত বেভারেজ বা কোমল পানীয়ের চাহিদা বাড়ে। গরমে দুগ্ধজাত পণ্য দই বা মাঠা সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক হলেও এগুলো নিয়ে সচেতনতা ও প্রচারে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন খুররাম নাঈম। 'বাংলাদেশে বেভারেজ পণ্যের মতো দুগ্ধজাত পণ্যের প্রচারণা থাকলে গ্রামে-গ্রামে হাজার হাজার লিটার দুধ নষ্ট হতো না। এদিকটায় নজর দিতে হবে,' বলেন তিনি।
আগস্টে বেকারি পণ্য বাজারের আনার পরিকল্পনা রয়েছে খুররামের। তিনি বলেন, 'পণ্যের মান বজায় রাখতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে পারি না। এজন্য বাই-প্রোডাক্ট (নির্ভরশীল পণ্য) তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি। ব্রেড, কেকসহ ৪টি পণ্য বাজারে আনার প্রক্রিয়া চলছে।'
এর পরের ধাপে শুকনো মিষ্টিও (ড্রাই সুইটস) আনা হবে বলে জানান তিনি। 'নিজের খামারের দুধ, ডিম কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা টেকসই হবে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ও কমবে।'